আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় সংস্কৃতি কি? অথবা, সংস্কৃতি কাকে বলে? সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্যসমূহ এবং বাংলাদেশের মানুষের সংস্কৃতি কেমন তার সম্পর্কে তার সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা।
সংস্কৃতি কি? সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্যসমূহ এবং বাংলাদেশের মানুষের সংস্কৃতি গুলো কি কি?

সংস্কৃতি কি?
সংস্কৃতি হলো একটি জীবনপ্রণালি। মানুষের ধ্যান-ধারণা, মূল্যবোধ ও পার্থিব উপকরণের সামগ্রিক রূপকেই সংস্কৃতি বলে। বৃদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন মান প্রজাতির সাথে সংস্কৃতির প্রত্যয়টি অতি নিবিড়ভাবে জড়িত।
মানুষের দৈনন্দিন জীবনের কাজকর্ম ও সাধনার দ্বারা সংস্কৃতির সৃষ্টি। জ্ঞান মানুষের বুদ্ধিকে গঠন করে আর সংস্কৃতি তার হৃদয়কে গঠন করে। মানব সৃষ্ট সবকিছুর সমষ্টি হলো সংস্কৃতি।
সংস্কৃতি : সংস্কৃতির ইংরেজি প্রতিশব্দ Culture। ইংরেজি Culture শব্দটি ল্যাটিন Colere শব্দ থেকে উৎপত্তি। Colere শব্দটির অর্থ কর্ষণ বা চাষ। সর্বপ্রথম ইংরেজি সাহিত্যে Culture শব্দটি ব্যবহার করেন ফ্রান্সিস বেকন ষোল শতকের শেষার্ধে।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা :
বিভিন্ন বিজ্ঞানী সংস্কৃতিকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। নিম্নে তাদের প্রদত্ত সংজ্ঞা দেওয়া হলো-
সমাজবিজ্ঞানী ম্যাকাইভার-এর মতে, আমরা মানুষ হিসেবে কি সে হলো আমাদের সংস্কৃতি।
সমাজবিজ্ঞানী ম্যালিনস্কির মতে, সংস্কৃতি মানুষেরই সৃষ্ট যার মাধ্যমে সে নিজের উদ্দেশ্য সাধন করে।
সমাজবিজ্ঞানী জোনস-এর মতে, মানব সৃষ্ট সব কিছুর সমষ্টিই হলো সংস্কৃতি ।
সমাজবিজ্ঞানী আর. টি শেফার-এর মতে, সংস্কৃতি হচ্ছে সমাজ থেকে অর্জিত এবং সামাজিকভাবে উত্তরসূরিদের মাঝে বর্তায় এমন আচরণসমূহের সামগ্রিক রূপ।
সমাজিবিজ্ঞানী রোজ-এর মতে, সব বস্তু ও অবস্তুর অবস্থার কৌশল হচ্ছে সংস্কৃতি। ম্যাথি ও আর্নল্ডের-মতে, সংস্কৃতি হচ্ছে খাঁটি হওয়া, মার্জিত হওয়া।
নৃবিজ্ঞানী ক্রোয়েবার-এর মতে, সংস্কৃতি হচ্ছে মনোজগতের অংশবিশেষ ।
র্যাঙ্ক লিনটন-এর মতে, সংস্কৃতি হচ্ছে আচরণের সামগ্রিক রূপ যা মানুষ কোন সমাজে বয়োজ্যেষ্ঠদের নিকট থেকে গ্রহণ করে এবং পরবর্তী বংশধরগণের নিকট তা অর্পণ করে।
উপরের সংজ্ঞাগুলোর আলোকে বলা যায়, সংস্কৃতি বলতে একটি জাতির আচার-আচরণ, মূল্যবোধ, কথা বলা, চলাফেরা, আচার-ব্যবহার, খাওয়া-পরা, ইত্যাদির আবেগিক বা মানসিক অবস্থা।
সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্যসমূহ কি কি?
মানুষ তার জ্ঞান-বুদ্ধি, কলাকৌশল ও নিজস্ব সৃজনশীল প্রচেষ্টার দ্বারা এবং বিজ্ঞানের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে যে সুন্দর জীবনব্যবস্থা গড়ে তোলে তার বাহ্যিক প্রতিফলই সংস্কৃতি। সংস্কৃতি হলো একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনধারা।
দেশ- কাল-পাত্রভেদে সংস্কৃতির ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। মানুষের ধ্যান-ধারণা, মূল্যবোধ ও পার্থিব উপকরণের সামগ্রিক রূপকেই বলা হয় সংস্কৃতি সংস্কৃতি হলো একটি জীবনপ্রণালি। সমাজের মানুষের জীবনযাত্রা প্রণালিই সংস্কৃতি
সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্যসমূহ :
সংস্কৃতি মানুষের ঐতিহ্য বহন করে। জাতিভেদে সংস্কৃতি ভিন্ন হয়ে থাকে। সংস্কৃতি বলতে বুঝায় মানুষের সৃষ্ট প্রতিবেশ আর তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে গড়ে ওঠা মানুষের আচার-আচরণ। নিম্নে সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হলো :
১. সংস্কৃতি শিখতে হয় :
সংস্কৃতি আপনা থেকেই গড়ে উঠে না; বংশপরম্পরায় সংস্কৃতি প্রবহমান। সংস্কৃতি উত্তরাধিকারসূত্রে পরবর্তী বংশধরগণের নিকট পৌঁছে। কিন্তু পরবর্তী বংশধরগণ অভিজ্ঞতা, অনুশীলন ও চর্চার মাধ্যমে পূর্ববর্তী সংস্কৃতিকে রপ্ত করে সংস্কৃতিকে শিখতে হয়। জাতিভেদে সংস্কৃতি ভিন্ন প্রকৃতির হয়ে থাকে। একজন ব্যক্তিকে সংস্কৃতি অনুশীলন করতে হয়।
২. সংস্কৃতি হচ্ছে কাঠামোভিত্তিক :
সংস্কৃতি শূন্যে অবস্থান করে না। সংস্কৃতির একটি কাঠামোভিত্তিক রূপ আছে। সেই রূপের মাধ্যমে সংস্কৃতির প্রকাশ ঘটে। সংস্কৃতির এই রূপটি বস্তুগত বা অবস্তুগত উভয় ধরনেরই হতে পারে।
৩. সংস্কৃতি বিভিন্ন উপাদানে গঠিত :
সংস্কৃতি বিভিন্ন উপাদান সহযোগে গঠিত হয়। মানবজীবনের বিভিন্ন দিক সংস্কৃতি গঠনে সাহায্য করে। মানুষের জৈবিক চাহিদা, পারিপার্শ্বিক অবস্থা, মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা এবং ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহ সংস্কৃতি গঠন করে। বস্তুতপক্ষে এতগুলো উপাদান ছাড়া সংস্কৃতি হতে পারে না।
৪. সংস্কৃতি বিভাজনযোগ্য :
সংস্কৃতি বিভিন্ন অংশ থাকতে পারে। সংস্কৃতি বিভিন্ন উপাদানসহযোগে গঠিত হয়। মানুষের ধ্যান-ধারণা, আচার-আচরণ ও সংগঠনের মাধ্যমে প্রকাশিত সংস্কৃতি সর্বযুগে সর্বস্থানে একই রূপ হয় না। সংস্কৃতি বিভাজনযোগ্য বলেই এরূপ হয়।
৫. সংস্কৃতি পরিবর্তনযোগ্য :
জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতি, রাষ্ট্রের কাজের ব্যাপকতা ও জটিলতা বৃদ্ধি এবং মানুষের জীবনযাত্রার মান পরিবর্তন ঘটার জন্য মানুষের আচার-আচরণ প্রতিষ্ঠানগুলোতে পরিবর্তন দেখা যায়। সুতরাং, এগুলোর উপর ভিত্তি করে স্বাভাবিকভাবেই মানুষের সংস্কৃতির পরিবর্তন ঘটে।
৬. সংস্কৃতি বিশ্লেষণযোগ্য :
সংস্কৃতি এক বা একাধিক নিয়ম দ্বারা পরিচালিত হয়। সংস্কৃতি নিয়মবহির্ভূত কোন বিষয় নয়। নিয়মানুবর্তী বৈশিষ্ট্যধারী কোন বিষয়কে বৈজ্ঞানিক উপায়ে বিশ্লেষণ করাও তাই সহজ মাধ্যম। সুতরাং, সংস্কৃতিকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বিশ্লেষণ করা যায় একথা অনস্বীকার্য।
৭. সংস্কৃতি সৃষ্টিশীল প্রকাশভঙ্গি অর্জনে সহায়তা করে :
সংস্কৃতি একটি যন্ত্র বা মাধ্যম বিশেষ। এই যন্ত্র বা মাধ্যমের সাহায্যে মানুষ সমাজে তার অবস্থান ও ভূমিকা সম্বন্ধে জ্ঞাত হয়। এর ভিত্তিতে সমাজে তার কতব্য কিরূপ হওয়া উচিত এ বিষয়টি সে নির্ধারণ কররে। তাই বলা যায় যে, সংস্কৃতি দ্বারা ব্যক্তি সামগ্রিক অবস্থা পুনর্বিন্যাস করে সৃষ্টিশীল প্রকাশভঙ্গি অর্জন করে ।
৮. সংস্কৃতি গতিশীল ও সর্বত্র বিরাজমান :
সংস্কৃতি স্থির থাকে না। আবার কোন সমাজই সংস্কৃতির অবস্থানকে অস্বীকার করতে পারে না। সংস্কৃতি অপরিহার্যতার কারণে তা সর্বদাই গতিশীল ও সর্বত্রই বিরাজমান। বংশপরম্পরায় সব দেশে ও সব যুগে সংস্কৃতি তাই গতিশীল ও বিরাজমান ।
বাংলাদেশের মানুষের সংস্কৃতি কেমন এবং কি কি?
সংস্কৃতি হলো জ্ঞান, বিশ্বাস, কলা, নীতিবোধ, আইন, প্রথা এবং সামাজিক মানুষের অর্জিত যাবতীয় কর্মদক্ষতা ও অভ্যাসের জটিল রূপ। বাংলাদেশের মানুষের নিজস্ব সংস্কৃতি বিদ্যমান।
সংস্কৃতি হলো একটি জীবনপ্রণালি। বাঙালি জাতি হিসেবে আমাদের চলা-ফেরা, খাওয়া-দাওয়া ভাষা, আচার-আচরণ ইত্যাদি সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে থাকে মানব সৃষ্ট সব কিছুর সমষ্টিই হলো সংস্কৃতি।
বাংলাদেশের মানুষের সংস্কৃতি :
মানুষের শিক্ষালব্ধ ও অর্জিত জ্ঞান, ধারণা ও অভ্যাস বংশপরম্পরায় বিস্তার লাভ করে। বাঙালি একটি স্বতন্ত্র জাতি। তাই বাঙালি জাতির নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে। নিম্নে বাংলাদেশের মানুষের সংস্কৃতি উল্লেখ করা হলো :
১. ভাষা : বাংলাদেশের মানুষের ভাষা বাংলা। তারা এই ভাষার কথা বলে, মনের ভাব প্রকাশ করে। বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংগীতের রয়েছে এক দীর্ঘ ঐতিহ্য। ১৯৫২ সালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে এদেশের ছাত্র-তরুণরা প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিল। বাংলাদেশের মানুষই একমাত্র ইতিহাসে ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিল। এদেশের সব লোক বাংলা ভাষায় কথা বললেও অঞ্চলভেদে আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে।
২. খাদ্যাভ্যাস : ভাত, ডাল, শাক-সবজি, মাছ বাংলাদেশের মানুষের প্রধান খাদ্য। সম্ভব হলে তিন বেলাই ভাত খায়। সকালে ঠাণ্ডা ভাত, দুপুরে ও রাতে রান্না করা ভাত, সাথে ডাল ও শাক-সবজি খেয়ে জীবন ধারণ করে। এছাড়া ভাতের সাথে মাছ মাংস খায়। উৎসব অনুষ্ঠানে পিঠা, পোলাও, মাংস ও পায়েসের আয়োজন করে। চিড়া, মুড়ি ও মুড়কির প্রচলন আজও আছে।
৩. পোশাক পরিচ্ছদ : বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ কৃষিকাজ করে বলে মাতলা মাথায়, খালি গায়ে, লুঙ্গি পরে মাঠে যায়। কৃষকেরা লুঙ্গি, ফতুয়া ও গামছা পরিধান করে। বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানে লুঙ্গির সাথে পাঞ্জাবি এবং কেউ কেউ প্যান্ট-শার্ট পরিধান করে। তরুণ সমাজ প্যান্ট, টি-শার্ট পছন্দ করে।
৪. ঘরবাড়ির আকৃতি : অঞ্চলভেদে ঘরবাড়ির ভিন্নতা থাকলেও সাধারণত বাঁশ, বেত, ছন ও খড় দিয়ে ঘরবাড়ি তৈরি করে। বাঁশ ও বেতের তৈরি বেড়া, বাঁশের খুঁটি এবং খড়ের ছাউনি দেয়া ঘরের আধিক্য লক্ষ্য করা যায়। মধ্যবিত্ত পরিবার টিনের ছাউনিতে বসবাস করে। এছাড়া ইটের তৈরি ঘরবাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবহাওয়া এবং মাটির গুণাগুণের ভিন্ন লক্ষ্য করা যায়।
৫. ধর্ম : বাংলাদেশের প্রায় শতকরা ৯০ ভাগ লোক ইসলাম ধর্মাবলম্বী। লোকসংখ্যার বাকি প্রায় ১০ ভাগ হিন্দু ধর্মাবলম্বী এবং অন্যরা বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারী। মুসলমানেরা মসজিদে, হিন্দুরা মন্দিরে, খ্রিস্টানগণ চার্চে এবং বৌদ্ধ প্যাগোডাতে উপাসনা করে। মুসলমানপ্রধান এ সমাজে মুসলমানদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান মসজিদ ।
৬. স্তরবিন্যাস : বাংলাদেশের সমাজ একটি শ্রেণি সমাজ। শ্রেণিগুলো উৎপাদনের উপায়ের মালিকানার ভিত্তিতে ক্রমোচ্চভাবে সজ্জিত। অন্যদিকে উঁচু-নিচু মর্যাদা ও অসম ক্ষমতা বণ্টনের ভিত্তিতে ক্রমোচ্চভাবে স্তরে বিভক্ত। একটি শ্রেণি অথবা মর্যাদা গোষ্ঠীর জীবনাচরণ এবং জীবন ধারণের পদ্ধতি কোন কোন ক্ষেত্রে অন্য শ্রেণির জীবন ধারণের পদ্ধতি থেকে ভিন্ন।
৭. খেলাধুলা : বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে নানা ধরনের দেশীয় খেলাধূলা, যেমন : কাবাড়ি, বৌচি, দাড়িয়া, গোল্লাছুট এবং বিদেশি খেলার মধ্যে ফুটবল সর্বাধিক জনপ্রিয়। এছাড়াও কোন কোন অঞ্চলে বিশেষ সময়ে ঘোড় দৌড়, সাঁতার ও পাতা খেলা লক্ষ্য করা যায়।
৮. অর্থব্যবস্থা : বাংলাদেশের গ্রাম সমাজে মূলত একটি সনাতন জীবনধারা এখনও বহমান। গ্রামবাসীর সহজ সরল জীবনের ছবি এখনও লক্ষ্য করা যায়। গ্রামের প্রধান অর্থব্যবস্থা কৃষি। অতএব সব গ্রামবাসীই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির সাথে জড়িত। কৃষিই তাদের জীবিকার প্রধান উৎস। কৃষি কাজই বাঙালিদের প্রধান পেশা।
পরিশেষে বলা যায় যে, সংস্কৃতি মানুষের জীবনধারা সামাজিক রূপ। একটি জাতির পরিচয় নিহিত থাকে তার সংস্কৃতির মধ্যে বাঙালি জাতির নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে।
সংস্কৃতি হলো কতগুলো আচার-আচরণ, ধ্যান-ধারণা যার মাধ্যমে আমরা একে অপরের সাথে যাবতীয় কার্যক্রম সম্পাদন করে থাকি। সংস্কৃতি সামাজিক বিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাঙালিদের বিশ্বাস, আশা-আকাঙ্ক্ষা, নৈতিকতা, ভাষা, মূল্যবোধ, অনুভূতি ইত্যাদির সমষ্টিই সংস্কৃতি।