ভূমির অধিকার ও কৃষি অর্থনীতি: বাংলাদেশের ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থার জটিলতা

বাংলাদেশের মতো একটি কৃষিপ্রধান অর্থনীতির জন্য 'ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থা' (Land Tenure System) কেবল একটি আইনি পরিভাষা নয়; এটি আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা, কৃষকের জীবনমান এবং সার্বিক অর্থনৈতিক উৎপাদনের একটি মৌলিক ভিত্তি। দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যমান এই উৎপাদন সম্পর্কগুলোই স্বল্প উৎপাদনের একটি মূল কারণ হিসেবে কাজ করে আসছে। আমার অভিজ্ঞতা বলে, বর্তমান ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থায় সত্যিকারের কৃষক, যারা জমিতে রাতদিন শ্রম দেন, তারা প্রায়শই অনুপস্থিত ভূ-স্বামী বা প্রভাবশালী জোতদারদের দ্বারা শোষিত ও ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, কৃষিপ্রধান দেশ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশে এখনো পর্যন্ত একটি সুষ্ঠু ও ন্যায়সঙ্গত ভূমি স্বত্ব ব্যবস্থা পুরোপুরি গড়ে ওঠেনি।
ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থার সংজ্ঞা ও অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য
আমরা যখন ভূমিস্বত্ব নিয়ে আলোচনা করি, তখন কেবল জমির মালিকানা নয়, বরং তার সাথে সম্পর্কিত আইন ও প্রথাগুলোকেও বুঝতে হবে।
ভূমিস্বত্ব: একটি বিস্তৃত প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাখ্যা
ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থা হলো এমন সকল প্রথা, বিধি বা আইনি কাঠামোর সমষ্টি, যা কোনো নির্দিষ্ট ভূমির ওপর কৃষক বা প্রজার অধিকার, মালিকানা, রাজস্ব ধার্য ও আদায়ের প্রক্রিয়া এবং জমির ব্যবহার সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়াদি নির্ধারিত করে। সোজা কথায়, এটি হলো ভূমি নিয়ন্ত্রণ এবং এর ব্যবহার সংক্রান্ত জনগণের অধিকার এবং সরকারি মালিকানা নির্ধারণের একটি পদ্ধতিগত কাঠামো। আইনবিদদের দৃষ্টিতে ভূমিস্বত্ব বলতে কেবল কৃষি জমি নয়, বরং জমির ওপর অবস্থিত বিল্ডিং, গাছপালাসহ যাবতীয় স্থাবর সম্পত্তির ওপর মানুষের অধিকারকেও বোঝায়।
ভূমিস্বত্বের তিনটি অপরিহার্য দিক
ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থা বিশ্লেষণ করতে গেলে তিনটি দিক অবশ্যই বিবেচনা করতে হয়, যা কৃষকের অর্থনৈতিক উদ্দীপনাকে সরাসরি প্রভাবিত করে:
- ভূমিস্বত্বের প্রকৃতি ও পরিধি: কৃষকের জমির ওপর মালিকানা কতটুকু স্থায়ী বা অস্থায়ী; তিনি কি কেবল প্রজা, নাকি পূর্ণ স্বত্বাধিকারী?
- উৎপাদন ইউনিটের আকার: কৃষি জমির খণ্ড খণ্ড হয়ে যাওয়া (Fragmentation) বা বৃহৎ জোতের (Large Holdings) আকার—উভয়ই উৎপাদনের দক্ষতা নির্ধারণ করে।
- অধিকারের সময়: কৃষক কত সময়ের জন্য জমি ভোগ দখল করতে পারবেন? যদি ইজারা স্বল্প মেয়াদের হয়, তবে কৃষক জমিতে দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত হন।
বাংলাদেশের কৃষিতে ভূমিস্বত্বের জটিলতা ও শোষণের সম্পর্ক
ঔপনিবেশিক আমলের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের (Permanent Settlement) উত্তরাধিকার বহন করার কারণে বাংলাদেশের ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থায় এখনো অনেক জটিলতা বিদ্যমান। কৃষিতে বিদ্যমান উৎপাদন সম্পর্কগুলো প্রায়শই ন্যায়সঙ্গত নয়।
জমিতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা
ভূমিহীন বা ভাগচাষীরা (Sharecroppers) সাধারণত অনুপস্থিত ভূ-স্বামীদের কাছ থেকে স্বল্প মেয়াদের জন্য জমি ইজারা নেন। আমার পর্যবেক্ষণ বলে, এই ভাগচাষীরা জানেন যে তারা আগামী বছরও এই জমি চাষ করতে পারবেন কিনা তা অনিশ্চিত। ফলে তারা জমিতে সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন, উন্নত বীজ ব্যবহার বা মাটির উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ করতে চান না। কারণ, বিনিয়োগের সুবিধা ভোগ করবে অনুপস্থিত ভূ-স্বামী বা পরবর্তী ইজারাদার। এই অনিশ্চয়তা সরাসরি কৃষিজ উৎপাদনের হারকে কমিয়ে দেয়।
ভূমি সংস্কারের অভাব ও জোতদার শ্রেণির আধিপত্য
দীর্ঘমেয়াদি ভূমি সংস্কারের অভাবের কারণে এখনো গ্রামীণ সমাজে জোতদার বা প্রভাবশালী শ্রেণির হাতে বিপুল পরিমাণ জমি কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে। এই শ্রেণির সদস্যরা নিজেরা সরাসরি কৃষিকাজে অংশ না নিয়েও কেবল ভূমির মালিকানার জোরে উৎপাদনের একটি বড় অংশ ভোগ করে থাকেন। অন্যদিকে, আসল কৃষক, যিনি জমিতে নিজের শ্রম ও ঘাম ঝরান, তিনি শোষিত হয়ে স্বল্প আয়ে জীবন ধারণ করেন। এটি কেবল অর্থনীতির নয়, বরং সামাজিক ন্যায়বিচারেরও একটি গুরুতর প্রশ্ন।
উপসংহার
পরিশেষে আমি জোর দিয়ে বলতে চাই, ভূমির উপর কৃষকদের ন্যায্য ভোগ স্বত্ব, ভূমি ব্যবহার সংক্রান্ত অধিকার ও মালিকানার স্পষ্টতা এবং ভূমি ও রাষ্ট্রের মধ্যে সুনির্দিষ্ট সম্পর্ক—এই সবকিছুই ভূমিস্বত্বের মূল বিষয়। বাংলাদেশের মতো দেশে স্থিতিশীল কৃষি উৎপাদন ও গ্রামীণ দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য বর্তমান ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনা এবং কৃষকদের জমির ওপর দীর্ঘমেয়াদী অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করা অত্যন্ত জরুরি। শুধুমাত্র আইন প্রণয়ন নয়, বরং সেটির যথাযথ প্রয়োগই আমাদের কৃষি অর্থনীতিকে সঠিক পথে চালিত করতে পারে।
If you believe any content on our website infringes your rights, please contact us. We will review and take action promptly.