ভারতবর্ষে মুসলিম ইতিহাসের উৎসসমূহ

আরবদের সিন্ধু বিজয় ও এর ফলাফল | ভারতে মুসলিম ইতিহাসের উৎসসমূহ, ইসলামের ইতিহাস, অসার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ,

আরবদের সিন্ধু বিজয় এর ফলাফল


সিন্ধু বিজয়

» প্রশ্ন : ১ ৷ ভারতে মুসলিম ইতিহাসের উৎসসমূহ আলোচনা কর। 

আরবদের সিন্ধু বিজয় ও এর ফলাফল, ভারতে বিজ্ঞানসম্মত ও সুষ্ঠু ইতিহাস রচনায় মুসলমানগণ পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেন। ভারতের রাজনৈতিক, শাসনতান্ত্রিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে মুসলমান শাসকদের শাসনব্যবস্থা একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। 

ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনামলের ঐতিহাসিক উপাদান পর্যবেক্ষণ করলে এর সত্যতা প্রমাণিত হয়। মূলত দেশটি মুসলমানদের ইতিহাসের বিভিন্ন উপাদানে ভরপুর। ঐতিহাসিক ডডওয়েল বলেন, “মুসলিম আমল শুরু হওয়ার সাথে সাথে ভারতে ধারাবাহিকভাবে ইতিহাস লেখা শুরু হয়, ফলে মুসলিম আমলের যেমন জীবনচিত্র পাওয়া যায়, হিন্দু আমল তেমনই ছায়াচ্ছন্ন।”

ভারতে মুসলিম ইতিহাস রচনার প্রধান উৎসসমূহ/উপাদানসমূহ: 

ভারতবর্ষে মুসলমানদের ইতিহাস জানার জন্য বিভিন্ন উৎস বা উপাদানের ওপর নির্ভর করতে হয়। ভারতের মুসলমানদের ইতিহাসের উৎস/উপাদানসমূহ নিম্নে আলোচনা করা হলো:

ক. প্রত্নতাত্ত্বিক উৎস : 

ভারতবর্ষে মুসলমানদের ইতিহাসের উৎস হিসেবে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের অবদান অত্যন্ত ব্যাপক। নিম্নে ভারতের মুসলমানদের ইতিহাসের প্রত্নতাত্ত্বিক উৎস সম্পর্কে বর্ণনা করা হলো—

১. শিলালিপি : 

শিলালিপি ভারতে মুসলমানদের ইতিহাসের অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য উপাদান। মুসলমান রাজাদের নির্মিত মসজিদ, প্রসিদ্ধ মাযার, স্তূপ প্রভৃতি স্থানে পাথর কিংবা তাম্রপাতের ওপর বিভিন্ন শিলালিপি রয়েছে। মুদ্রা থেকেও বেশি তথ্য এসব শিলালিপি থেকে পাওয়া যায়। সাধারণত রাজা বা রাজকর্মচারীদের উপস্থিতিতে আরবি ও ফারসি ভাষায় শিলালিপি উৎকীর্ণ হতো। 

সে কারণে এর বিশ্বাসযোগ্যতা খুব বেশি। শিলালিপিতে সাধারণত কুরআনের আয়াত, হাদীস, শ্লোক, সুলতানের নাম-পরিচয়, উৎকীর্ণকারীর নাম-পরিচয়, তারিখ ইত্যাদি লিপিবদ্ধ থাকে। সুতরাং মুসলমানদের ইতিহাস জানার ক্ষেত্রে শিলালিপির গুরুত্ব অত্যন্ত ব্যাপক

২. স্থাপত্যশিল্প ও ললিতকলা : 

মুঘল আমলের স্থাপত্যশিল্প ও সূক্ষ্ম কারুকার্য, উৎকর্ষ ও বৈশিষ্ট্য মুঘল সম্রাটদের উন্নত রুচিবোধ তথা মুসলিম সংস্কৃতির পরিচয় পাওয়া যায়। সে আমলের স্মৃতিস্তম্ভ, প্রস্তর মূর্তি, পোড়ামাটির ফলক এবং অট্টালিকাগুলোতে হিন্দু ও মুসলিম শিল্পকৌশলের সংমিশ্রণের সুস্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। স্মৃতিস্তম্ভ ও অট্টালিকাগুলো সে সময়ের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় অবস্থার চিত্র আমাদের সামনে তুলে ধরে।

৩. মুদ্রা : 

সুলতান বা তাঁর উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের প্রত্যক্ষ তদারকির মাধ্যমে মুদ্রা উৎকীর্ণ হতো বলে ইতিহাসের উৎস হিসেবে এর গ্রহণযোগ্যতা সর্বাগ্রে। 

মুদ্রা থেকে মুসলমানদের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলির সঠিক তারিখ, মুদ্রা উৎকীর্ণের সময়, স্থান, ব্যয়ভার, টাকশালের নাম, মুদ্রাভিত্তিক সভ্যতা তথা সামাজিক ও অর্থনৈতিক মান সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। 

যে স্থান থেকে মুদ্রা চালু হতো সে স্থানের নাম, সে সময়ের রাজা-বাদশাহর নাম ও উপাধি মুদ্রা থেকে পাওয়া যায়। সুতরাং ভারতের মুসলমানদের ইতিহাসের উৎস হিসেবে মুদ্রার সাক্ষ্য সর্বাপেক্ষা মূল্যবান ।

৪. ধ্বংসাবশেষ : 

ঐতিহাসিক স্থানের ধ্বংসাবশেষও ভারতবর্ষের মুসলমানদের ইতিহাস জানার ক্ষেত্রে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। মুসলমান রাজাদের নির্মিত নানা ধরনের কারুকার্যখচিত সৌধাদির ভগ্নাবশেষ, মৃৎশিল্প ইত্যাদির দ্বারা সে সময়ের স্থাপত্যশিল্প সম্পর্কে অবগত হওয়া যায়। 

মুসলিম সভ্যতা সম্পর্কে ধারণা লাভের জন্যও এগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শহর-নগরের ধ্বংসাবশেষ থেকেও মুসলমানদের ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। 

খ. ঐতিহাসিক রচনাবলি : 

মুসলমানদের লেখা গ্রন্থাবলি ভারতীয় মুসলমানদের ইতিহাসের উৎস হিসেবে অত্যন্ত মূল্যবান উপাদান। এসব ঐতিহাসিক রচনা ও সাহিত্য সাধারণত আরবি ও ফারসি ভাষায় লেখা হতো। নিম্নে এগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:

১. চাচনামা : 

আরবি ভাষায় রচিত ‘চাচনামা' গ্রন্থ থেকে আরবদের সিন্ধু বিজয় সম্পর্কে অবগত হওয়া যায়। ফারসি ভাষায় এর অনুবাদ করেন আলি বিন হামিদ কুফি। এ গ্রন্থে মুহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু অভিযানের পূর্বে ও পরে সিন্ধু দেশের অবস্থা বর্ণিত হয়েছে। এতে বহু অঞ্চলের নাম ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলি লিপিবদ্ধ আছে। একে আরবদের সিন্ধু বিজয়ের প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। 

২. তুজুক-ই জাহাঙ্গিরী ও পাদশাহনামা : 

'তুজুক-ই জাহাঙ্গিরী' মুসলিম শাসনামলের একটি নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ। এতে সম্রাট জাহাঙ্গীরের আত্মজীবনী বর্ণিত হয়েছে। 

এছাড়া সম্রাট শাহজাহান ও আওরঙ্গযেবের শাসনকালের তথ্যসংবলিত গ্রন্থ হলো কাফি খানের 'মুন্তাখাব-উল লুবাব', আবদুল হামিদ লাহোরীর ‘পাদশাহনামা' এবং 'মা-আসির-ই আলমগীর'। এসব গ্রন্থ ভারতবর্ষের মুসলমানদের ইতিহাস জানার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ।

৩. কিতাব-উল হিন্দ : 

ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমান যুগের মূল্যবান রচনা হলো আল-বিরুনী রচিত 'কিতাব-উল হিন্দ'। ৯৭০ খ্রিস্টাব্দে আল বিরুনী সুলতান মাহমুদের সাথে ভারতে আসেন। এখানে তিনি ভারতীয় পণ্ডিতগণের সংস্পর্শে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। 

এ সময় তিনি 'কিতাব উল হিন্দ' নামক বিখ্যাত গ্রন্থটি রচনা করেন। তাঁর এ গ্রন্থ থেকে এগারো শতকের প্রারম্ভে ভারতের শাসনব্যবস্থাসহ ধর্ম, বিজ্ঞান, সাহিত্য ও দর্শন সম্বন্ধে অনেক মূল্যবান তথ্য পাওয়া যায়।

৪. তারিখ-ই সিন্দ : 

'তারিখ-ই সিন্দ' গ্রন্থখানি মীর মুহাম্মদ মাসুম ষোলো শতকে রচনা করেন। এ গ্রন্থে আরবদের সিন্ধু অভিযানের সময় 'থেকে সম্রাট আকবরের রাজত্বকাল পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলি লিপিবদ্ধ আছে। আরবদের সিন্ধু অভিযানের পটভূমি ও মুহাম্মদ বিন কাসিমের সাফল্যের কারণগুলো এতে লিপিবদ্ধ হয়েছে।

৫. খাওয়াজিন-উল ফুতুহ : 

আমীর খসরু ছিলেন দিল্লির সুলতানি আমলের বিখ্যাত ঐতিহাসিক। তিনি জালালউদ্দিন খিলজী থেকে মুহাম্মদ বিন তুঘলক পর্যন্ত দিল্লির সুলতানদের সমসাময়িক ছিলেন। 

তিনি সুলতান আলাউদ্দিন খিলজীর সভাসদের পদ অলঙ্কৃত করেছিলেন। তিনি বহু উল্লেখযোগ্য ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ায় তাঁর বিবরণীর ঐতিহাসিক মূল্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। 'খাওয়াজিন-উল ফুতুহ' গ্রন্থে আলাউদ্দিন খিলজীর দাক্ষিণাত্য, বরঙ্গল ও মেবার অভিযান, তাঁর প্রশাসনিক সংস্কার, মুঘল আক্রমণ প্রভৃতি বিষয়ের বিবরণ সন্নিবেশিত হয়েছে। 

আমীর খসরুর অন্যান্য ঐতিহাসিক গ্রন্থের মধ্যে 'কিরান-উস সাদাইন', 'মিফতাহ-উল ফুতুহ', 'ইজাজে খসরু', 'তুঘলকনামা' প্রভৃতির মাধ্যমেও সমসাময়িক যুগের মুসলমানদের ইতিহাস সম্পর্কে অবগত হওয়া যায়। 

৬. তাবাকাত-ই নাসিরী : 

মিনহাজ-উস সিরাজ রচিত 'তাবাকাত-ই নাসিরী' দিল্লি সালতানাতের প্রাথমিক যুগের ইতিহাস সংবলিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। এ গ্রন্থে বাংলা-উড়িষ্যার বিজয় কাহিনী, ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাস প্রভৃতির বর্ণনা স্থান পেয়েছে। এ গ্রন্থটি লেখক সুলতান নাসিরউদ্দিন উৎসর্গ করেন।

৭. তারিখ-ই ফিরোজ শাহী : 

জিয়াউদ্দিন বারানি রচিত 'তারিখ-ই ফিরোজ শাহী' গ্রন্থখানি ভারতের মুসলমানদের ইতিহাসে এক অমূল্য সম্পদ। জিয়াউদ্দিন নিজেই মুহাম্মদ বিন তুঘলক ও ফিরোজ শাহ তুঘলকের সভাসদ ছিলেন।

 তিনি সুলতান বলবনের সিংহাসনারোহণের সময় থেকে (১২৬৬ খ্রি.) শুরু করে সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলকের রাজত্বের প্রথম ছয় বছর পর্যন্ত (১৩৫৭ খ্রি.) সময়ের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেন। আলাউদ্দিন খিলজী ও মুহাম্মদ বিন তুঘলকের রাজস্ব সংস্কারগুলোর মনোজ্ঞ বিবরণ এতে সন্নিবিষ্ট রয়েছে। 

শামস-ই সিরাজ আফিফ রচিত 'তারিখ-ই ফিরোজ শাহী'-তে সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক কর্তৃক বাংলাদেশ আক্রমণের বিবরণ পাওয়া যায়। তাছাড়া সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলকের স্বরচিত চিত্তাকর্ষক গ্রন্থ 'ফুতুয়াত-ই ফিরোজ শাহী'-তে তাঁর শাসনব্যবস্থার বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায় ।

৮. তারিখ-ই মুবারক শাহী :

সুলতান মুবারক শাহের রাজত্বকালে ইয়াহিয়া বিন আহম্মদ বিন আবদুল্লাহ সরহিন্দ 'তারিখ-ই মুবারক শাহী' গ্রন্থটি রচনা করেন। এ গ্রন্থে সুলতান মুহাম্মদ ঘুরী থেকে আরম্ভ করে ১৪২৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দিল্লির সুলতানদের ইতিহাস লিপিবদ্ধ হয়েছে। ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস জানার ক্ষেত্রে এটি একটি অন্যতম উৎস।

৯. তারিখ-ই শেরশাহী : 

আব্বাস খান শেরওয়ানী রচিত 'তারিখ-ই শেরশাহী' গ্রন্থখানি ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানদের ইতিহাসের উপাদান হিসেবে উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে। সমসাময়িক ইতিহাস জানার ক্ষেত্রে তাঁর এ গ্রন্থটির যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। 

কারণ এতে সৈয়দ, লোদী ও শূর আমলের শাসনব্যবস্থাসহ তৎকালীন আর্থ-সামাজিক অবস্থার বিস্তারিত বর্ণনা উল্লেখ করা হয়েছে।

১০. ফুতুহ-উস সালাতীন : 

খাজা আবদুল মালিক ইসামী রচিত গ্রন্থ 'ফুতুহ-উস সালাতীন' মহাকাব্য শাহনামার অনুসরণে লেখা বলে একে "শাহনামা-ই হিন্দ' বলা হয়। এটি এগারো শতকের শুরু থেকে চৌদ্দ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত মুসলিম ভারতের একটি সুন্দর ঐতিহাসিক কাব্য। 

এতে মুহাম্মদ বিন তুঘলকের শাসনকালের (১৩২৫-৫১ খ্রি.) ঘটনাবলি উল্লিখিত হয়েছে। কে. এস. লাল তাঁর History of the Khaljis গ্রন্থে বলেন- It was the out come of the broken heart of an unknown poet. অর্থাৎ, এটি ছিল একজন আশাহত ও অখ্যাত কবির সৃষ্টিশৈলী।

১১. তারিখ-ই ফিরিশতা:

সুলতান ইবরাহীম আদিল শাহের সময়ে সুলতানি আমলের বিবরণ সংবলিত 'তারিখ-ই ফিরিশতা' গ্রন্থটি রচনা করেন আবুল কাসিম ফিরিশতা। এতে বাংলাদেশের ইতিহাসসহ সমগ্র ভারতবর্ষের মুসলমানদের ঐতিহাসিক কাহিনীর বর্ণনা স্থান পেয়েছে।

১২. রিয়াজ-উস সালাতীন : 

বাংলাদেশের বিস্তারিত ইতিহাস জানতে গোলাম হোসেন সলিম রচিত 'রিয়াজ-উস সালাতীন' গ্রন্থের ভূমিকা অনন্য। এটি অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত গ্রন্থ। কারণ গ্রন্থকার বহু ঘটনা প্রত্যক্ষ করে তা রচনা করেছেন। 

এতে ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মুসলিম বাংলার সমগ্র ঐতিহাসিক ঘটনাবলি অতি সুন্দরভাবে আলোচনা করা হয়েছে। তাছাড়া এ গ্রন্থে বিহার ও উড়িষ্যার নবাবদের আলোচনা এবং পলাশী যুদ্ধ ও পরবর্তী ঘটনাবলিও উল্লেখ করা হয়েছে।

১৩. মুস্তাখাব-উত তাওয়ারিখ : 

আবদুল কাদির বদাউনি ভারতবর্ষের মুসলমানদের ইতিহাস নিয়ে 'মুন্তাখাব-উত তাওয়ারিখ' গ্রন্থটি রচনা করেন। তিনি খাঁটি মুসলিম ছিলেন বলে তাঁর গ্রন্থে তিনি আকবরের ধর্মনীতির তীব্র সমালোচনা করেন। তিনি গজনভী বংশ থেকে শুরু করে আকবরের শাসনামলের ৪০ বছরের ইতিহাস এ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেন ।

১৪. বাবুরনামা : 

জহিরউদ্দিন মুহাম্মদ বাবুরের আত্মজীবনী 'বাবুরনামা' মুঘল সম্রাটদের ইতিহাস জানার ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। এ গ্রন্থে বাবুর তাঁর ব্যক্তিজীবনের সকল দোষগুণ অকপটে স্বীকার করেছেন এবং এতে তদানীন্তন ভারতবর্ষের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত নিখুঁতভাবে বর্ণিত হয়েছে।

১৫. আকবরনামা ও আইন-ই আকবরী : 

মুঘল সম্রাট আকবরের সভাসদ ও প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক আবুল ফজলের বিখ্যাত 'আইন-ই আকবরী' এবং ‘আকবরনামা’ গ্রন্থ দুটি থেকে সম্রাট আকবরের রাজত্বকাল সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায়। 

আকবরের রাজত্বকালের নির্ভরযোগ্য ইতিহাস রচনায় উল্লিখিত গ্রন্থ দুটি খুবই গুরুত্ববহ। এছাড়া নিজামুদ্দিন আহমদ বখশির 'তাবাকাত-ই আকবরী' আকবরের শাসনামলের আরেকখানা গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক গ্রন্থ।

১৬. সিয়ার-উল মুতায়াখখিরীন, লুবাব ও পদুমাবৎ : 

সাইয়েদ গোলাম হোসেন তাবে তাবেঈন ভারতবর্ষের ইতিহাস নিয়ে লিখেছেন 'সিয়ার-উল মুতায়াখখিরীন'। এতে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার মুসলমানদের ইতিহাস বর্ণিত আছে। এছাড়া সফিউদ্দিন মোহাম্মদ আওয়াফী রচনা করেন 'লুবাব' নামক গীতিকবিতা। 

হিন্দুস্থানের প্রাচীনতম কবি জায়সী রচনা করেন 'পদুমাবৎ' ও 'আখরাওয়াত'। এসব গ্রন্থে মুসলমানদের আর্থ-সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানের বর্ণনা করা হয়েছে।

গ. পর্যটকদের বর্ণনা : 

ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের ইতিহাসের উৎস হিসেবে পর্যটকদের ভ্রমণবৃত্তান্ত অত্যন্ত মূল্যবান। নিম্নে কয়েকজন পর্যটকের ভ্রমণবৃত্তান্ত আলোচনা করা হলো—

১. এশীয় পর্যটক : 

ভারতবর্ষে যে সকল পর্যটক আগমন করেছেন তাদের মধ্যে মাহুয়ান ও আবদুর রাজ্জাক অন্যতম। পনেরো শতকে চৈনিক পর্যটক মাহুয়ান ও পারস্যের আবদুর রাজ্জাক ভারতবর্ষ ভ্রমণান্তে এদেশের চমৎকার বর্ণনা প্রদান করেছেন। তাদের বর্ণনা দ্বারা বাংলাদেশের সমকালীন সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার এক মনোজ্ঞ চিত্র ফুটে ওঠে

২. ইউরোপীয় পর্যটক : 

ভারতবর্ষের মুসলমানদের ইতিহাস সম্পর্কে সর্বাধিক তথ্য জানা হায় ইউরোপীয় পর্যটকদের কাছ থেকে। সুলতানি আমলে ইতালীয় পর্যটক মার্কো পোলো ও নিকোলো-ডি কন্টি দক্ষিণ ভারতে আগমন করেন।

 তাদের বর্ণনায় এলাকার সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার সার্বিক চিত্র ফুটে উঠে এছাড়া পর্তুগিজ পর্যটক পায়েজ, বার্বোসা, নুনিজ ও রুশ পর্যটক নিকিতিনির বর্ণনা হতেও মধ্যযুগীয় ভারতের মুসলিম শাসনামলের অনেক তথ্য পাওয়া যায়। 

আমলের প্রসিদ্ধ ইউরোপীয় পর্যটকদের মধ্যে র‍্যালফ ফিচ টেরি, ট্যাভার্নিয়ার, পার্টাস, বার্নিয়ার, মানুচি, টমাস রো, ভাস্কো-দা-গামা, ক্যাবোরি, ভারপেমা, সিজার ফ্রেডারিক, জোয়াও দ্য বেরস প্রমুখের বর্ণনা থেকে সে সময়কার জনসাধারণের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়।

৩. আফ্রিকান পর্যটক : 

মুসলিম শাসনামলে ভারতবর্ষে যেসব পর্যটকের আগমন ঘটে তাদের মধ্যে আফ্রিকার মরক্কো থেকে আগত ইবনে বতুতা অন্যতম। তিনি তাঁর 'রাহলা' (ভারত ভ্রমণ) গ্রন্থে মুহাম্মদ বিন তুঘলকের রাজত্বকাল, ভারতবাসীর আচার-ব্যবহার ও ভারতের সাধারণ অবস্থার এক মনোজ্ঞ বিবরণ তুলে ধরেন, যার মাধ্যমে সহজেই সমসাময়িক মুসলমানদের ইতিহাস সম্পর্কে অবগত হয়। 

ঘ. বিবিধ উৎস : 

উল্লিখিত উৎস ছাড়াও আরো কয়েকটি উৎস থেকে ভারতবর্ষের মুসলমানদের ইতিহাস সম্বন্ধে জানা যায়। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো— 

১. সরকারি দলিল-দস্তাবেজ ও চিঠিপত্র : 

ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের ইতিহাস জানার ক্ষেত্রে মুঘল ও সুলতানি আমলের সরকারি দলিল-দস্তাবেজ ও ব্যক্তিগত চিঠিপত্র মূল্যবান উৎস হিসেবে পরিগণিত। মুঘল সম্রাটদের সরকারি নথিপত্র বিশেষভাবে সংরক্ষিত ছিল, যা পরবর্তীকালে মুঘল ইতিহাসের বহু তথ্য সরবরাহ করেছে। 

সম্রাট আকবরের গ্রন্থাগারে প্রায় চব্বিশ হাজার পাণ্ডুলিপি সংরক্ষিত ছিল। এছাড়া তাঁদের ব্যক্তিগত চিঠিপত্র এবং দিনপঞ্জিও মুসলমানদের ইতিহাসের উৎস হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করে।

২. আদমশুমারি ও পরিসংখ্যান : 

ভারতবর্ষে মুসলমানদের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে সে সময়কার আদমশুমারি ও অন্যান্য পরিসংখ্যান অন্যতম উৎস হিসেবে গণ্য । গ্যাজেটিয়ার ও বিভিন্ন পরিসংখ্যান রিপোর্ট, গ্রামবাংলার বংশানুক্রমিক ঘটনা, সংরক্ষিত স্থানীয় ঐতিহ্যসমূহ থেকেও তৎকালীন মুসলিম ইতিহাস সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য অবগত হওয়া যায়।

৩. জনশ্রুতি : 

ভারতীয় মুসলমানদের ইতিহাস রচনার মূল্যবান উপাদান হিসেবে জনশ্রুতি বা কিংবদন্তির গুরুত্ব অত্যন্ত ব্যাপক। কেননা মধ্যযুগে দেশীয় ঐতিহাসিকদের দ্বারা পরিকল্পিত কোনো ইতিহাস রচিত হয়নি। 

ফলে বর্তমানকালের ধারাবাহিক ইতিহাস রচনার জন্য মধ্যযুগের জনশ্রুতি বা কিংবদন্তি আমাদেরকে তৎকালীন অনেক ঘটনার তথ্য দেয়, যা অন্য কোনো উৎস থেকে জানা যায় না ।

উপসংহার : 

ভারতবর্ষের মুসলমানদের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে ঐতিহাসিকদের প্রত্নতাত্ত্বিক উৎস, সাহিত্যিক উপাদান ও পর্যটকদের বর্ণনার ওপর নির্ভর করতে হয়। কারণ তখন কোনো ধারাবাহিক ইতিহাস রচনা করা হয়নি। 

তদুপরি সমকালীন ঘটনাপঞ্জির যেসব উৎস ও উপকরণ পাওয়া গেছে তা দিয়ে ভারতের মুসলমানদের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থার বিবরণ সম্পর্কে একটি বাস্তব চিত্র পাওয়া যায় ।


আরবদের সিন্ধু বিজয় ও এর ফলাফল, আরবদের সিন্ধু বিজয় ও এর ফলাফল, আরবদের সিন্ধু বিজয় ও এর ফলাফল, আরবদের সিন্ধু বিজয় ও এর ফলাফল, আরবদের সিন্ধু বিজয় ও এর ফলাফল, আরবদের সিন্ধু বিজয় ও এর ফলাফল, আরবদের সিন্ধু বিজয় ও এর ফলাফল,

আরবদের সিন্ধু বিজয় ও এর ফলাফল, আরবদের সিন্ধু বিজয় ও এর ফলাফল, আরবদের সিন্ধু বিজয় ও এর ফলাফল, আরবদের সিন্ধু বিজয় ও এর ফলাফল, আরবদের সিন্ধু বিজয় ও এর ফলাফল, আরবদের সিন্ধু বিজয় ও এর ফলাফল, আরবদের সিন্ধু বিজয় ও এর ফলাফল,

Post a Comment