খোলাফায়ে রাশেদীন বলতে কী বুঝ? ও তাদের বৈশিষ্ট্যসমূহ

প্রশ্ন : ৭২ ৷৷ খেলাফত ও খোলাফায়ে রাশেদীন বলতে কী বুঝ? খোলাফায়ে রাশেদীনের বৈশিষ্ট্যাবলি বর্ণনা কর।, খোলাফায়ে রাশেদীন বলতে কী বুঝ? খোলাফায়ে রাশেদীনে
Follow Our Official Facebook Page For New Updates


Join our Telegram Channel!

প্রশ্ন : ৭২ ৷৷ খেলাফত ও খোলাফায়ে রাশেদীন বলতে কী বুঝ? খোলাফায়ে রাশেদীনের বৈশিষ্ট্যাবলি বর্ণনা কর। (What do you mean by Kholafaye Rashedin? and their characteristics)

খোলাফায়ে রাশেদীন বলতে কী বুঝ?

উপস্থাপনা : 

ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনায় খেলাফত একটি উত্তম ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান। আর খোলাফায়ে রাশেদীন এ প্রতিষ্ঠানের সুযোগ্য পরিচালনা পর্ষদ। 
মহানবী (স)-এর পরেই এ পরিচালনা পর্ষদের স্থান। এ সম্পর্কে পি. কে. হিট্টি বলেন, 
This (Khelafat was a period in which the lustre of the Prophet's life had not ceased to shed it's light History of the Arabs o

খেলাফতের পরিচয়:

ক. আভিধানিক অর্থ : খেলাফত আরবি শব্দ। এটি (খলিফাতুন) বিশেষ্যের ক্রিয়ামূল। অর্থ প্রতিনিধি। 

খ. পারিভাষিক সংজ্ঞা:
১. ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায়, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কর্তৃত্ব স্বীকার করে নিয়ে আল্লাহর বিধান মোতাবেক তাঁর প্রতিনিধিত্ব করার নাম খেলাফত। 
এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় শাসনে আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব করাকেই খেলাফত বলে। যেমন আল্লাহ তায়ালা হজরত দাউদ (আ)-কে নির্দেশ দিয়েছিলেন -- یا داؤد انا جعلتك خليفة في الأرض فاحكم بين الناس بالحق ولا تتبع الهـوى فيضلك عن سبيل الله. 

২. মজীদ খাদ্দুরীর মতে, খেলাফত হচ্ছে ধর্মের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত ইহলৌকিক নেতৃত্বের একটি প্রতিষ্ঠান।

৩. আবদুল ওয়াহাব নাজ্জার বলেন, খেলাফত হচ্ছে একটি ধর্মীয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। 

৪. ঐতিহাসিক ইবনে খালদুন বলেন, মহানবী (স)-এর পর তাঁর আদর্শ প্রচার এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার নামই খেলাফত ।

৫. কেউ কেউ বলেন, খেলাফত হলো, অর্থাৎ, মহানবী (স) প্রদর্শিত পন্থায় তাঁর প্রতিনিধিত্ব করা।

খোলাফায়ে রাশেদীনের পরিচয়:

ক. আভিধানিক অর্থ : 

আরবি খোলাফা শব্দটি বহুবচন, এর একবচন খলিফা আর রাশেদীন শব্দটিও বহুবচন, একবচনে রাশেদ। এক্ষেত্রে খোলাফায়ে রাশেদীন শব্দটি বহুবচন, 
আর একবচনে খলিফায়ে রাশেদ। এর আভিধানিক অর্থ সুপথ প্রাপ্ত, যথোপযুক্ত, স্থলাভিষিক্ত ইত্যাদি ।

খ. পারিভাষিক সংজ্ঞা : 

ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায়, মহানবী (স)-এর ইহকাল ত্যাগের পর যিনি ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনায় নেতৃত্ব, বিশ্বস্ততা, জীবনযাপন, শাসন প্রণালি প্রভৃতি বিষয়ে মহানবী (স)-এর হুবহু অনুসরণ অনুকরণ করেন, 
তাঁকে খলিফায়ে রাশেদ বলা হয়। সাধারণ অর্থে, প্রকৃত দায়িত্বশীল ব্যক্তির পক্ষে উত্তরসূরি কর্তৃক তাঁর দায়িত্ব পালন করাকেই খলিফা বা প্রতিনিধি বলে।

খোলাফায়ে রাশেদীন: 

খোলাফায়ে রাশেদীন বলতে রাসূল (স)-এর ওফাতের পর তাঁর স্থলাভিষিক্ত প্রথম চার জন খলিফাকে বোঝায়। তাঁরা হলেন- 
১. হজরত আবু বকর ইবনে আবু কুহাফা (রা), 
২. হজরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা), 
৩. হজরত ওসমান ইবনে আফ্ফান (রা) ও 
৪. হজরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা)। 
এ সকল মহৎ ব্যক্তিই ছিলেন মহানবী (স)-এর প্রকৃত উত্তরাধিকারী। তাঁদের অনুসরণ অনুকরণ করতে মহানবী (স) নির্দেশ দিয়েছেন। 
নবুয়তের . বিষয় ব্যতীত মহানবী (স)-এর প্রায় সকল কার্যক্রমের গুরুদায়িত্ব অর্পিত হয় খলিফাদের ওপর। মোট কথা, দ্বীন ধর্ম ও রাজনীতির সকল শাখা প্রশাখায় খলিফাগণ মহানবী (স)-এর প্রকৃত উত্তরাধিকারী। 
এ সকল মহান ব্যক্তিত্বই ছিলেন খোলাফায়ে রাশেদীন, রাসূলুল্লাহ (স) যাঁদের অনুসরণ অনুকরণের আদেশ দিয়ে গেছেন।

খোলাফায়ে রাশেদীনের বৈশিষ্ট্যাবলি:

১. কুরআনের অনুসরণ : 

খোলাফায়ে রাশেদীনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আল কুরআনের অনুসরণ। তাঁরা কখনো এমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি, যাতে কুরআনের কোনো বিধান থেকে বিচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিতে পারে। 
মহান আল্লাহর ঘোষণা— “আমি তার জন্য করেছি এমন এক জ্যোতি, যার ওপর ভর করে সে মানুষের মাঝে চলে ।”

২. হাদীস মোতাবেক চলা : 

খোলাফায়ে রাশেদীন সর্বদা রাসূল (স)-এর পদাঙ্ক অনুসরণ করতেন। তাঁরা কখনোই রাসূল (স)-এর হাদীস পরিপন্থী কোনো কাজ করতেন না। 

৩. পূর্ণ সত্যবাদী : 

খলিফাগণ ছিলেন পূর্ণ সত্যবাদী এবং সত্যবাদিতার মূর্ত প্রতীক। স্বার্থের কারণে, বিপদের সময় বা কোনো সংকটময় মুহূর্তেও তাঁরা সামান্যতম মিথ্যার আশ্রয় নেননি।

৪. পূর্ণ ঈমানদার:

খলিফাদের ঈমানের গভীরতা ছিল অস্বাভাবিক। যত বড় সঙ্কটজনক পরিস্থিতিই তাঁদের কাছে আসত, তাঁদের দৃঢ় অবিচল ঈমান থেকে তাঁদের সামান্যতমও টলাতে পারতো না।

৫. আত্মশুদ্ধি : 

খলিফাদের আত্মা ছিল সম্পূর্ণ অনাবিল পূতপবিত্র। কোনো পাপ পঙ্কিলতা তাঁদের স্পর্শ করতে পারতো না।

৬. সত্যোপলব্ধি : 

খলিফাদের অন্তকরণে এমন এক অপার্থিব উপলব্ধি ছিল, যার মাধ্যমে তাঁরা সত্য ও মিথ্যা দিবালোকের মতো স্পষ্ট করে নিতে পারতেন।

৭. ক্ষমতার প্রতি অনাগ্রহ : 

খলিফাদের কেউই কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার লোভে খলিফা নির্বাচিত হননি; বরং গণমানুষের কল্যাণে তাদের দ্বারাই তারা খলিফা নির্বাচিত হয়েছেন। এমনকি তাঁদের কারো কারো ক্ষেত্রে বৃহত্তর জনস্বার্থে অনিচ্ছা সত্ত্বেও খলিফা হতে হয়েছে ।

৮. কুটিলতা ও সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে : 

খলিফাগণ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত সকল কূটিলতা ও সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে ছিলেন। বিশেষ কোনো অঞ্চল, গোত্র বা বর্ণভেদ তাঁদের খেলাফতের কার্যক্রমে প্রভাব ফেলেনি।

৯. পরামর্শভিত্তিক শাসনব্যবস্থা : 

খোলাফায়ে রাশেদীন পরামর্শ মোতাবেক খেলাফত পরিচালনা করতেন। তাঁদের খেলাফতের কর্মনীতি সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, অর্থাৎ, তাঁদের (খলিফাদের) কার্যক্রম পরিচালিত হয় পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে।

১০. ন্যায়পরায়ণতা : 

খেলাফতের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল ন্যায়পরায়ণতা, ইনসাফভিত্তিক সাম্যবাদ। হজরত ওমর (রা), তাঁর গভর্নরদের প্রতি এক নির্দেশে বলেন, 
“তুমি সকল মানুষের মধ্যে সমতা স্থাপন করবে তোমার উপস্থাপনায়, তোমার ন্যায়বিচারে এবং তোমার মজলিসে। 
যাতে অভিজাত ব্যক্তি তোমার দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করতে না পারে আর দুর্বল ব্যক্তি তোমার ন্যায়পরায়ণতা থেকে নিরাশ হয়ে না পড়ে। ”

১১. মৌলিক গুণাবলি : 

খোলাফায়ে রাশেদীনের মাঝে পরিপূর্ণ মৌলিক মানবিক গুণাবলি বিদ্যমান ছিল। তাঁরা ছিলেন সহজ, সরল, সদয়, দয়ালু, দানশীল, সত্যবাদী, প্রতিশ্রুতি পালনকারী, ন্যায়পরায়ণ। 
এসব কারণেই তাঁরা সাফল্যের সাথে খেলাফতের মহান দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হন।

১২. মৌলিক মানবাধিকার পূরণের নিশ্চয়তা : 

খোলাফায়ে রাশেদীনের শাসনব্যবস্থায় অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ মানুষের সর্বপ্রকার মৌলিক মানবাধিকার পূরণের নিশ্চয়তা ছিল। 
শুধু মানুষই নয়, অন্য প্রাণীদের অধিকার রক্ষায়ও তাঁরা সচেষ্ট ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে তাঁদের বৈশিষ্ট্যের আলোচনা শেষ হওয়ার মতো নয়। 
হজরত ওমর (রা) বলেছেন, ইরাক ভূ-খণ্ডে একটি বকরিও যদি বিধ্বস্ত হয় তবে আমি আশঙ্কা করছি আল্লাহর নিকট ওমরকে এ বিষয়ে জবাবদিহি করতে হবে।

১৩. আল্লাহর সার্বভৌমত্ব : 

খলিফাগণ পৃথিবীর কোনো শক্তিকে ভয় করতেন না, ভয় করতেন : কেবল মহান আল্লাহকে। 
বিশ্ববিখ্যাত রোম ও পারস্য সাম্রাজ্যের বিশাল শক্তিকেও তাঁরা ভয় করেননি; বরং আল্লাহর সার্বভৌমত্বকেই মনেপ্রাণে ধারণ করেছিলেন।

১৪. মত-প্রকাশের স্বাধীনতা : 

খলিফাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তাঁদের সময়ে জনগণের মত-প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা। 
হজরত ওমর (রা) একবার নারীদের মহরের পরিমাণ কম ধার্য করার মত ব্যক্ত করলে এক নারী এর প্রতিবাদ . করেন। তা শুনে হজরত ওমর (রা) বলেন, of all অর্থাৎ, মহিলাটি সঠিক বলেছে, ওমর ভুল করেছে।

১৫. ব্যক্তিগত মতামত জনগণের ওপর চাপিয়ে না দেয়া : 

খোলাফায়ে রাশেদীনের প্রত্যেকেই তাঁর পরবর্তী খলিফা মনোনীত না করে জনগণের মতের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। 
কোনো প্রদেশের গভর্নর নিয়োগের বিষয়েও খলিফা স্থানীয় নাগরিকদের মতামত নিয়েছেন। আবার নাগরিকদের আপত্তির ভিত্তিতে খলিফা প্রাদেশিক গভর্নরদের অনেককে পরিবর্তনও করেছেন।

১৬. অমুসলিমদের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা সংরক্ষণ : 

খোলাফায়ে রাশেদীন অমুসলিমদের সর্বপ্রকার অধিকার ও স্বাধীনতা যথাযথভাবে রক্ষা করেছেন। 
মূলত তাঁদের সুশাসন ও অসাধারণ গুণাবলির কারণেই তাঁদের সময় দলে দলে মানুষ ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল।

উপসংহার : 

পরিশেষে বলা যায়, খোলাফায়ে রাশেদীন ছিলেন সত্য, সুন্দর, ন্যায় ও উত্তম আদর্শের প্রতীক। তাঁদের বৈশিষ্ট্যের আলোচনা শেষ করা যাবে না। 
তাঁদের শাসন বৈশিষ্ট্য থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে আমাদেরও তাঁদের অনুসৃত ইসলামী প্রজাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চর্চায় উদ্বুদ্ধ হতে হবে ।

Post a Comment

Cookie Consent
We serve cookies on this site to analyze traffic, remember your preferences, and optimize your experience.
Oops!
It seems there is something wrong with your internet connection. Please connect to the internet and start browsing again.
AdBlock Detected!
We have detected that you are using adblocking plugin in your browser.
The revenue we earn by the advertisements is used to manage this website, we request you to whitelist our website in your adblocking plugin.
Site is Blocked
Sorry! This site is not available in your country.