ফেইসবুকে আমাদের সকল আপডেট পেতে Follow বাটনে ক্লিক করুন।
কিশোর গল্প : ধর্মের কল বাতাসে নড়ে | Kishor Golpo: Dhormer Kol Batashe Nore
লেখক: অপূর্ব দত্ত

আচমকা পেছন থেকে ডাকটা একদম পছন্দ নয় সুশীতলবাবুর। বিশেষ করে কোনো শুভ কাজে বেরোবার সময় তো কখনোই নয়। নামের সঙ্গে এ ব্যাপারে কোনো সামঞ্জস্যই নেই তাঁর।
এমনিতে চাল-চলনে, আচার-আচরণে স্বভাবগতিতে মোটামুটি নরম-সরম ভাব থাকলেও পেছনে কেউ ডাকলেই তাঁর মেজাজটা আর সুশীতল থাকে না; অসম্ভব কুপিত হয়ে পড়েন। যেমন হলেন আজকে, এই খানিক আগে।
সকাল সকাল উঠে স্নান-ফান সেরে ছাদে গিয়ে সূর্যের দিকে তাকিয়ে ‘ওঁ জবাকুসুম সঙ্কাশং’ বললেন। তারপর কাচা ধুতি-পাঞ্জাবি পরে চুল আঁচড়ে বগলে ছাতা নিয়ে বেরোলেন। বারান্দায় থেকে গিন্নি ‘দুগ্গা দুগ্গা' বললেন।
গলায় আঁচল জড়িয়ে জোড়হাত কপালে ঠেকালেন। চৌকাঠ পেরিয়ে দরজাটা ভেজিয়ে রাস্তায় পা দিয়েছেন কী দেননি, পেছন থেকে কর্কশ গলার আওয়াজ—“সুশতলদা, ও সুলদা, কোথায় চল্লেন সাতসকালে?”
কোনো উত্তর নেই। দেবার প্রয়োজনও মনে করলেন না। চুপচাপ হাঁটতে লাগলেন। রতন পাকড়াশীর কয়লার গোলার কাছে আসতেই আবার সেই হেঁড়ে গলা—
“ও সুলদা, বলি এত হন্তদন্ত হয়ে কোথায় যাচ্ছেন? কীসের এত তাড়া? পালের দোকানের এক ভাঁড় চা খেয়ে গেলে হত না?”
সুশীতলবাবু অনেকক্ষণ ধরেই শুনে আসছিলেন। পেছনে না তাকিয়েই গলার আওয়াজ আর কথা বলার ধরন দেখে বুঝে নিয়েছিলেন লোকটা আর কেউ নয়, সামনের বাড়ির নিকামায়ে আশুতোষ চক্কোত্তি। দেখলে পিত্তি চটকে যায়। ধর্মের কল বাতাসে নড়ে
সাত জন্মে কথা বলেন না তার সঙ্গে। অথচ লোকটা সকলের সব কিছুর মধ্যে থাকে। চাঁদিফাটা রোদ্দুরে ক্লান্ত গলদঘর্ম হয়ে দুহাতে দুটো ভারী ব্যাগ নিয়ে বাজার থেকে ফিরছি, বেচু সিকদারের তেলেভাজার দোকানের বেঞ্চিটা থেকে ভেসে এল—“সুলদা, কটা বাজে দেখুন তো।”,
ভাবুন অবস্থাটা। পিত্তি চটকে যায় কিনা বলুন। দেখছে দুহাতে দুখানা দশ কেজির ব্যাগ, ঘাড় বেঁকে যাচ্ছে, তার মধ্যে বাবুকে টাইম বলতে হবে। এ কী হাওড়া স্টেশনের সামনে দিয়ে যাচ্ছি নাকি যে বড়ো ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় বলা যাবে ? কিংবা ধরুন আপনি টালিগঞ্জে অটোর লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন, সামনে পঞ্চাশজন লোক।
লাল-হলুদ ছোপলাগা দাঁত নিয়ে একগাল হেসে আপনার ঘাড়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে জিজ্ঞেস করল—“ওয়ার্ল্ড কাপ দেখছেন তো? ইংল্যান্ড, জার্মানি যতই তড়পাক, ব্রাজিলকে বিট করতে পারবে না, বলুন। রোনাল্ডো, রোনাল্ডিনহো, কার্লোস, কাফুদের চটকই আলাদা, বলুন। শিল্পী, বলুন।”
কেউ এমন করলে পিত্তি চটকায় কিনা। মাঝে মাঝে মনে হয়, দিই ওর নাকে একটা ঘঁষি বসিয়ে। সব প্রশ্নের মধ্যে একটা “বলুন” জুড়ে দেবে। আরে বাবা, আমি কি তোর ইয়ার দোস্ত, না তুই আমার দাবা খেলার পার্টনার, যে সব কথা বলতে হবে।
ভালো করে কথা বলতে পারে না। জীবনে কখনো ‘সুশীতল' বলতে পারল না। স্ স্ করে ‘সুল’ বলে। দেব একদিন কুকুরটাকে লেলিয়ে। হাড়ে হাড়ে টের পাবে। পালাবার পথ পাবে না ।
আপন মনে বিড়বিড় করতে করতে হেঁটে যাচ্ছেন সুশীতলবাবু। বেশ বুঝতে পারছেন আশুতোষ চক্কোত্তি তাঁর তিন ফুটের মধ্যে এসে গেছে। হাওয়াই চপ্পলের ফ্যাট্ ফ্যাট্ আওয়াজ কানে আসছে। বিরক্তিকর লাগছে। জুতো ঘেষটে ঘেষটে চলা একেবারে পছন্দ করেন না তিনি।
মনে মনে ওর মুণ্ডপাত করে ছাড়ছেন। একবার ভাবলেন দাঁড়িয়ে দু'কথা শুনিয়ে দেবেন। কিন্তু ওর মতো অসভ্য বর্বর আহাম্মকের সঙ্গে বাক্যবিনিময় দূরের কথা, মুখদর্শন করতে ইচ্ছে করে না। তার ওপর একটা শুভকাজে বেরোচ্ছেন। চিঠিখানা আজকে ডাকে না দিলেই নয়।
অনেক চেষ্টাচরিত্তির করে মেয়ের জন্যে একটা সত্যিকারের ভালো পাত্রের সন্ধান পাওয়া গেছে। কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন বক্স নম্বর দিয়ে। তেত্রিশখানা চিঠি এসেছে। তার থেকে বেছেবুছে মনের মতো একটা পাত্র ঠিক করেছেন। সবদিক থেকে ভালো। ইঞ্জিনিয়ার।
মাল্টিন্যাশানাল কোম্পানিতে মোটা মাইনের চাকরি করে। বাবা-মার একমাত্র সন্তান। কলকাতায় নিজের বাড়ি। কোনো দাবিদাওয়া নেই। সকালবেলা গৃহদেবতার আশীর্বাদ নিয়ে চলেছেন পোস্ট অফিসে চিঠিখানা ডাকবাক্সে ফেলার জন্য। ধর্মের কল বাতাসে নড়ে
সুশীতলবাবু মানুষটা কারোর সাতে পাঁচে থাকেন না। মানে থাকতে চান না। পাড়াতেও কারোর সঙ্গে কস্মিনকালেও মেশেন না। বাড়ি আর অফিস, অফিস আর বাড়ি করে কাটিয়ে দিয়েছেন এতটা কাল। অবশ্য এ পাড়ায় উনি বেশিদিন যে এসেছেন তাও নয়। পাশের পাড়ায় বাড়ি ভাড়া নিয়ে অনেককাল ছিলেন। চাকরি করতেন ব্যাংকে।
অফিসারও হয়েছিলেন। নানা জায়গায় বদলি হয়েছেন। তবে পরিবার নিয়ে কখনো যাননি। মেয়ের পড়াশোনার জন্য ওদের নিতেন না। একা একাই হাত পুড়িয়ে খেয়েছেন। বছর দুয়েক হল এ পাড়ায় জমি কিনে বাড়ি করেছেন। মাস দুয়েক আগে রিটায়ারও করেছেন।
ফলে পাড়ার লোকের সঙ্গে ওর স্ত্রী-কন্যার যা মেলামেশা বা পরিচয় তার কণামাত্রও ওঁর নেই। তাছাড়া সুশীতল সান্যাল লোকটা বেশ আপনভোলা। কোনো কিছুই ভালো করে খেয়াল করেন না। অনেকটা হাতে চশমা নিয়ে বাড়িময় তোলপাড় করে চশমা খুঁজে বেড়ানোর মতো।
আগে নাকি বেশ ভুলো ছিলেন। বাজারের থলে হাতে বেরিয়ে বাজার ভুলে গিয়ে বন্ধুর বাড়িতে দাবা খেলে দু'ঘন্টা বাদে খালি ব্যাগ নিয়ে বাড়ি ফিরে গিন্নির মুখনাড়া খেয়েছেন। একবার তো সাংঘাতিক কাণ্ড করে বসেছিলেন।
নিকট আত্মীয়ের বিয়ের নেমন্তন্নে গিয়ে আর একটা বিয়েবাড়িতে এক ভরি সোনার হার উপহার দিয়ে পেটপুরে খেয়ে এসেছিলেন। কী কারণে সেদিন তাঁর বউ-মেয়ে যেতে পারেননি। বাড়ি ফিরতেই গিন্নি আর মেয়ে যখন জিজ্ঞেস করেছিল
যে বিয়েবাড়ি গিয়ে বাড়ির আত্মীয়স্বজন, কাউকে দেখলে না, এমনকি যার বিয়ে, মানে আমাদের মেয়ে মলিকেও চিনতে পারলে না, তখন মুখটা কাঁচুমাচু করে বলেছিলেন— “একদম খেয়াল করিনি।” কতদিন অফিস যাবার সময় খালি পায়েই বেরিয়ে পড়তেন।
যখন পায়ে কিছু ফুটত বা ভিড় বাসে কেউ পা মাড়িয়ে দিত তখন খেয়াল হত। এছাড়া ভুল ট্রেনে ওঠা, ভুল বাসে চড়া, জামাকাপড় ইস্ত্রি করাতে নিয়ে গিয়ে টেলারিংএর দোকানে দিয়ে দেওয়া এ তো তাঁর রোজকারের ঘটনা ছিল। ধর্মের কল বাতাসে নড়ে
একবার তো টেলিফোন অপিসের ড্রপ বক্সে ইলেকট্রিক বিল আর চেক ফেলে চলে এসেছিলেন। সাপ্লাই থেকে লাইন কেটে দিতে ব্যাংকের পাশবুক দেখে তাঁর খেয়াল হয়েছিল। সাংসারিক কাজে বারংবার ভুল করলেও অফিসের কাজে কখনো ভুল করতেন না। নিখুঁত। পারফেক্ট। ব্যাংক অফিসারের দায়িত্বপূর্ণ কাজ ঠিকভাবেই সামলেছেন।
তবে জীবনের সবচেয়ে মারাত্মক ভুলটা করেছিলেন বাড়ি করার সময়। অফিসের সহকর্মীর সঙ্গে পাশাপাশি দুটো প্লট কিনেছিলেন। ভিত পুজোর দিন সহকর্মীর প্লটে ঘটা করে ভিতপুজো করেছিলেন। শেষে সেদিন কী ভাগ্যিস সময়মতো সহকর্মী বন্ধুটি এসে পড়েছিলেন তাই বাঁচোয়া।
তারপর থেকে নাক-কান মলেছেন। ইদানীং 'আর বিশেষ ভুলটুল করেন না। সবসময় সাবধানে কাজ করেন। তা ছাড়া মেয়ে, বউ একেবারে গোয়েন্দার মতো চোখেচোখে রাখে। নকড়ি হালদারের গমকলের কাছে আসতেই আশুতোষ চক্কোত্তি লাফ মেরে সামনে এসে দাঁড়াল। এক গাল হেসে জিজ্ঞেস করল— “দাদা কি আমার ওপর রাগ করেছেন ?
আচ্ছা, কথায় কথায় রাগ করলে চলে, বলুন। কালকে সহবাগের ব্যাটিংটা দেখলেন তো। কী খেলা না খেলল, বলুন। ইন্ডিয়ার কেউ একজন প্রথম লাঞ্চের আগে সেঞ্চুরি করল ক্যারিবিয়ানদের বিরুদ্ধে। ফারুক ইঞ্জিনিয়ার লাঞ্চের আগে নাইনটি ফোর করেছিল। সহবাগের ক্যালি আছে, বলুন। ইন্ডিয়ার ওনলি ট্রিপল সেঞ্চুরিয়ান।”
সুশীতল সান্যাল আর সুশীতল থাকতে পারছেন না। মাথার ভেতরটা গরমে ফুটছে। রগের কাছটা দপদপ করছে। দাঁতে দাঁত চেপে আছেন। সত্যি বলতে লোকটাকে এত কাছ থেকে এই প্রথম দেখলেন। একবার ভাবলেন লোকটাকে এমন শিক্ষা দেবেন যেন জীবনে আর কখনও তাঁর সঙ্গে কথা বলতে না আসে। অনেক কষ্টে রাগ সংবরণ করলেন। ধর্মের কল বাতাসে নড়ে
“পোস্টাপিসে যাচ্ছেন? চিঠি পোস্ট করবেন? আর্জেন্ট লেখা রয়েছে দেখছি। পোস্টাপিসের কথা আর বলবেন না। কোনো দায়দায়িত্ব নেই, বলুন। অথচ আগে কী ছিল, বলুন। লিখতে না লিখতেই পৌঁছে যেত। আর এখন? এইজন্যেই তো কুরি....”
পাঞ্জাবির বুকপকেট থেকে খামটা হাতে নিয়ে পাশ-পকেটে রাখলেন। লোকটার যা স্বভাব হট করে না জিজ্ঞেস করে বসে কার চিঠি, কীসের চিঠি, কাকে লিখেছেন ইত্যাদি ইত্যাদি।
কুনজর না লেগে যায়। শুভকাজ বলে কথা। অবশ্য এর মধ্যেই লেগে গেছে কিনা কে বলতে পারে। পকেটের ভেতর থেকেই চিঠিটা ছুঁয়ে কপালে হাত ঠেকালেন।
“বিয়ে-থার ব্যাপার বুঝি? কার? কন্যার ? আপনার তো একটিই সন্তান, তাই না সান্যালমশাই? তা, ঠিকই করেছেন। সময়মতো বিয়ে-থা দিয়ে দেওয়াই ভালো, বলুন। বুঝলেন কিনা সান্যালমশাই, আমারও একটিই সন্তান। ভাবছি এবার ছেলেটারও বিয়ের বন্দোবস্ত করব। দু-একটা খোঁজখবর পেয়েছি। ঝামেলা মিটিয়ে দেওয়াই ভালো, বলুন। বলছেন না কেন ? ”
সুশীতলবাবু আর মেজাজ আয়ত্তে রাখতে পারলেন না। অনেকক্ষণ ধরে বলুন বলুন' শুনে ধৈর্যের পাঁচিল ভেঙে গেছে। বিরক্তি প্রকাশ না করেই ঝাঁঝের সঙ্গে বললেন—“কী বারবার ‘বলুন বলুন' করছেন। কী বলতে হবে বলুন। আপনার সঙ্গে আমার পিরিতের কারণ কিছু আছে? বলুন।”
আশুতোষ চক্কোত্তির মুখের হাসিটা কিন্তু অকপট। পান খেয়ে খেয়ে দাঁতে ছোপ ধরে গেলেও হাসবার সময় গাল ছড়িয়ে হাসেন। মুখের মধ্যে কোনোরকম বিরক্তি বা শয়তানি-ভণ্ডামির চিহ্নমাত্র থাকে না। গদগদ হয়ে একগাল হাসি নিয়ে বললেন
— “আপনিও তো প্রত্যেক কথার শেষে একটা 'বলুন' লাগাচ্ছেন। আর আমি 'বলুন' বললে আপনি রেগে যাচ্ছেন। আচ্ছা বলুন, কথার শেষে এই যে ‘বলুন' বলার অভ্যাস এটা কি খারাপ? বলুন। শুনতে বেশ ভাল্লাগে না, বলুন। কেমন একটা অ্যাকসেন্ট, মানে অনেকটা দলবৃত্ত ছন্দের মতো একটা শ্বাসাঘাত লাগে, না? বলুন। যাগে ওসব কথা ছাড়ুন। বলুন তো সুতলদা, সোনার দামটা যে সেনসেক্স-এর মতো হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে এটা কেমন কথা। ছেলেটার বিয়ের যোগাযোগ করছি। কিছু যদি একটা লেগে যায় তখন কী হবে বলুন। রিটায়ার করেছি। তার ওপর একটা বাড়িও.....।”
সুশীতলবাবুর আর শুনতে ভালো লাগছিল না। শুভকাজে দেরি হলে বা বাগড়া পড়লে মন খারাপ হয়ে যায়। চক্কোত্তিমশাইকে দুটো ঠান্ডাগরম কথা শোনাবার ইচ্ছেটাকেও কাজে লাগাতে পারছেন না। লোকটাকে দূর থেকে দেখেছেন বা কণ্ঠস্বর শুনেছেন আগে অনেকবার। কিন্তু একেবারে সামনে, মানে করমর্দন দূরত্বে, যাকে বলে রেঞ্জের মধ্যে এই প্রথম পেলেন।
রাগ চেপে রেখে বললেন—“আপনি মশাই বেশ নাছোড়বান্দা দেখছি। দেখছেন তাড়া আছে। জরুরি কাজে যাচ্ছি। পথ আগলে খোশগপ্পো শুরু করলেন। অন্য অনেক লোক তো রয়েছে, তাদের সঙ্গে সুখ-দুঃখের কথা বলুন না। আমাকে ছেড়ে দিন। দরকারি কাজ রয়েছে।”
আশুতোষ চক্কোত্তি হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়েন আর কী। মিনিট দুয়েক ধরে ঘাড় এপাশ ওপাশ করে হেসে নিয়ে মোলায়েম করে বললেন – “বটেই তো, বটেই তো। দোষ তো আমারই। আপনাকে খামোকা আটকে রাখলাম। উচিত কাজ হয়নি, বলুন। নিশ্চয় পোস্টাপিসে যাচ্ছিলেন চিঠি ডাকবাক্সে ফেলতে। বুকের কুলুঙ্গিতে উঁকি মারছিল, দেখেছি। ধর্মের কল বাতাসে নড়ে
তবে পাশ-পকেটে রাখার দরকার ছিল না। বুঝতে পারছিলাম বিয়ে-থার ব্যাপার। কোণায় হলুদের টিপ দেখেই ধরেছি। বেশ করেছেন। যান, আপনাকে আর আটকাব না। আমার মেয়ে না থাকলেও ছেলের বিয়ের সম্পর্ক করতে গিয়ে টের পেলাম কন্যাদায় কী জিনিস।
মেয়ের বাপেদের উদ্বেগ উৎকণ্ঠার কোনো পরিমাপ হয় না, বলুন। চুপ করে থাকবেন না। বলুন হয় কিনা। হয় না, হয় না সান্যালমশাই। আমি জানি, হয় না ।”
সুশীতলবাবু আস্তে আস্তে পালটে যাচ্ছেন। এই লোকটার সম্বন্ধে কত কিছু ভেবে বসে আছেন। মনে মনে কত গালাগাল দিয়েছেন। অথচ একবারও তাঁর মনে এল না লোকটা কত কিছু জানে।
ওয়ার্ল্ড কাপ ফুটবল, রোনাল্ডো- রোনাল্ডিনহো-কার্লোস- কাফুদের নাম, সোনার দাম, সেনসেক্স, সহবাগের ব্যাটিং, লাঞ্চের আগে সেঞ্চুরি মিস করা, ট্রিপল সেঞ্চুরি, এমনকি দলবৃত্ত ছন্দ অব্দি অকপটে উগরে দিচ্ছে। লোকটা নিশ্চয় শিক্ষিতই হবে।
কিছুটা আপশোশের ভঙ্গিতে বললেন—“আপনি তো রাস্তার উলটো দিকের বাড়িটাতেই থাকেন, তাই না?”
আশুতোষ চক্কোত্তি এবার জোরে না হেসে ঠোঁটে হাসলেন। ভাবটা যেন—কী! দিলাম তো তোমার মাথা থেকে রাগের পাহাড়টা নামিয়ে। মোলায়েম করে বললেন— “আজ্ঞে না, সান্যালমশাই।
আমি এপাড়া ছেড়ে গেছি বছর দুয়েক আগে। মানে আপনি বাড়ি করলেন, আর আমিও চলে গেলাম। নর্থ ক্যালকাটায় আমার ছেলে বাড়ি করেছে। জমিটা অবশ্য পৈতৃক। তবে ভিতপুজোটা ঠিক নিজের জমিতেই করেছিল।”
সুশীতলবাবু লজ্জা পেলেন। মনে মনে ভাবলেন লোকটাকে এতদিন নিকামায়ে অসভ্য বর্বর আহাম্মক কত কিছুই না ভেবেছেন। এখন দেখা যাচ্ছে পুরোটাই উলটো। বরং লোকটা কর্মঠ, জ্ঞানী, সামাজিক, মিশুকে এবং সর্বোপরি শিক্ষিত। ধর্মের কল বাতাসে নড়ে
সাধারণত হেসে কথা বলার অভ্যেস না থাকলেও মুখে চেষ্টিত হাসি ফুটিয়ে বললেন—“প্রায়ই আপনাকে এ পাড়ায় পথে-ঘাটে-বাজারে দূর থেকে দেখি, এমনকি ওই হলুদরঙা বাড়িটায় ঢুকতে বেরোতে দেখি বলে ভাবতাম ওখানেই আপনি থাকেন।”
পকেট থেকে পানের ডিবে বের করে একটা পান গালে দিয়ে ডিবেটা এগিয়ে বললেন—“চলবে?”
“আজ্ঞে না। ধন্যবাদ।” ধর্মের কল বাতাসে নড়ে
“বুঝলেন কিনা সান্যালমশাই, এ পাড়াটাকে বড্ড ভালোবেসে ফেলেছি। আপনি ঠিকই ধরেছেন। আপনি তো দু'বছর এসেছেন। পাড়ার খবর-টবর বিশেষ রাখেন না। ওই বাড়িটা আমার এক বন্ধুর।
একটা বিশেষ কাজে আমাকে মাঝেমধ্যেই আসতে হয়। তা ছাড়া এখানে আমার অনেক মানুষের সঙ্গে আত্মার সম্পর্ক। তাই দূরে চলে গেলেও সপ্তাহে দু-তিনদিন আসতেই হয়। আশ্চর্য হলেন? বলুন।”
মুখে কিছু না বললেও, সুশীতলবাবু এবার সত্যিই আশ্চর্য হলেন। মানুষকে ওপর থেকে দেখে কিছুই বোঝার উপায় নেই। চক্কোত্তিমশাইকে জিজ্ঞেস করলেন—“আপনি এখন কী করেন? মানে চাকরিবাকরি?”
“ও কিছু না। ও কিছু না। এখন কিস্যু কাজের কাজ করি না, সব অকাজের সাক্ষী হয়ে বেঁচে আছি। আগে একটু আধটু মাস্টারি করার চেষ্টা করতাম। এখন তাও করি না। যাক গে, আপনাকে আর আটকার না। অনেক সময় নষ্ট করলাম।
ও হ্যাঁ, যে কথাটা বলবার জন্য আপনাকে ডাকছিলাম। আমার আর হয়তো এদিকে ঘন ঘন আসা হবে না। আমি নর্থ ক্যালকাটায় থাকি। ওদিকে গেলে যাবেন। আশা করছি, র্যাদার প্রার্থনা করছি, আপনার যাত্রা শুভ হোক।
দেখবেন আবার হয়তো কোনোদিন হুট করে দেখা হয়ে যেতে পারে। বলুন পারে কিনা। পারে পারে। রিলিজিয়নস্ মেশিন মুস ইন দি এয়ার। ঠিক কিনা বলুন।”
সুশীতলবাবু চুপ করে আছেন দেখে আবার শুরু করলেন “বুঝলেন না তো? ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। এবারে বুঝলেন? বলুন। আচ্ছা চলি। ও হ্যাঁ, আর একটা কথা আপনি যতই আমাকে অ্যাভয়েড করুন আর অপছন্দই করুন, আমি কিন্তু আপনাকে খুব পছন্দ করি।
আমার ছেলের জন্যও খোঁজাখুঁজি করছি। কাগজের বিজ্ঞাপন দেখে দু-একটা চিঠিও দিয়েছি। তা, যদি লেগে যায় তা হলে কিন্তু নেমন্তন্ন করব। অবশ্যই আসতে হবে সপরিবার। দেখা হবে চলি।”
সুশীতলবাবুর মনটা আজ সত্যিই বেশ সুশীতল। বারান্দায় বসে হাতের খামটা বারবার নেড়েচেড়ে দেখছেন। মুক্তোর মতো অক্ষরে লেখা সমীরণ সান্যাল, ৭/৩, মোহিনী কুণ্ডু লেন, কলকাতা-৩৪। প্রেরকের নামের জায়গায় সংক্ষেপে লেখা শম্ভুনাথ চক্রবর্তী, বেলগাছিয়া, কলকাতা।
মেয়ের ফটো পাঠিয়ে যে চিঠিটা পাঠিয়েছিলেন, তার উত্তর এসেছে। ছেলে খড়গপুর আই আই টি-র ইঞ্জিনিয়ার। একমাত্র সন্তান। ছেলের বাবা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির হেড অফ দা ডিপার্টমেন্ট ছিলেন।
সম্প্রতি রিটায়ার করে অনাথ ছেলেমেয়েদের জন্য অনেকগুলো স্কুল করে দিয়েছেন। মেয়ের ফটো দেখে তাদের সম্পূর্ণ পছন্দ হয়েছে। ছেলের বাড়িঘরদোর দেখে আসতে অনুরোধ জানিয়েছেন। পছন্দ হলে ওঁরা মেয়ে দেখতে আসবেন ।
মেট্রো রেলে বেলগাছিয়া স্টেশনে নেমে রিকশায় সস্ত্রীক চলেছেন সুশীতলবাবু। গিলে করা আদ্দির পাঞ্জাবি আর কোঁচানো ধুতি। হাতে নামী দোকানের মিষ্টির বাক্স। ধর্মের কল বাতাসে নড়ে
ঠিকানা মিলিয়ে বাড়ি খুঁজে রিকশা থেকে নামলেন। ঝকঝকে সদ্য রং করা দোতলা বাড়ি। গেটের পাশে পাথরের ফলকে লেখা – অধ্যাপক শম্ভুনাথ চক্রবর্তী, এম এ, ডি ফিল। গেট খুলে ভেতরে ঢুকে 'আসুন, আসুন সান্যালমশাই' শুনে চমকে উঠলেন
সুশীতলবাবু। ভূত দেখছেন নাকি। কী গেরো। এখানেও সেই আশুতোষ চক্কোত্তি! লোকটা তা হলে ঘটক নাকি! নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেন না।
“আসুন, ম্যাডাম। অবাক হচ্ছেন নিশ্চয়ই।” সুশীতলবাবু আমতা আমতা করে বললেন – “আপনি এখানে? এটা শম্ভুনাথ চক্রবর্তীর বাড়ি না? উনি আছেন?”
“আরে মশাই, এখনও রাগ করে আছেন মনে হচ্ছে। রাস্তা থেকেই কথা বলবেন নাকি? ভেতরে আসুন। রাগ পুষে রাখলে চলে, বলুন?”
“না, মানে শম্ভুনাথবাবু কি আপনার আত্মীয়, না বন্ধু ?”
আর একবার হাসিতে ফেটে পড়লেন আশুতোষ চক্কোত্তি। এ হাসি বড়ো চেনা। কিন্তু একটুও বিরক্তির সঞ্চার হল না সুশীতল সান্যালের মনে। সোফায় বসতে বসতে বললেন, “শম্ভুনাথবাবু আছেন তো?”
“বিলক্ষণ আছেন। সশরীরে আপনার সামনে বসে আছেন। চিমটি কেটে দেখতে
পারেন। আমারই নাম শম্ভুনাথ চক্রবর্তী। আশুতোষ আমার ডাক নাম। পোশাকি নাম শম্ভুনাথ। আপনার বাড়ির উল্টোদিকের বাড়িটা, যেটাতে আপনি আমাকে ঢুকতে বেরোতে দেখতেন সেটা আসলে একটা অনাথ আশ্রম। স্ট্রিট চাইল্ডদের জন্য একটা সমাজসেবা বলতে পারেন। বসুন, চায়ের কথাটা আগে বলে আসি।”
সুশীতলবাবু আর একবার লজ্জিত হলেন। না জেনে কত বিরূপ ধারণাই না পোষণ করেছিলেন ওঁর সম্বন্ধে। কত বড়ো মাপের মানুষ। উচ্চশিক্ষিত, তার ওপর সমাজসেবী।
এ রকম ঘরে মেয়ের বিয়ে দেওয়া তো ভাগ্যের ব্যাপার। কুণ্ঠার সঙ্গে বললেন— “কিছু মনে করবেন না চক্রবর্তীমশাই। না জেনে আপনাকে হয়তো কটূক্তি করে থাকতে পারি। আপনি তো ঘুণাক্ষরেও কখনও বলেননি আপনিই অধ্যাপক শম্ভুনাথ চক্রবর্তী। এরকম হেঁয়ালির কোনো অর্থ আছে, বলুন।”
“দূর মশাই, আপনার সঙ্গে আমার সামনাসামনি কথাই তো হল মাত্র সেদিন। অন্যদিন তো দূর-দর্শন। দূরের থেকে মানুষ বোঝা যায়? চেনা যায়? মানুষ চিনতে হলে তার মনের তলদেশ ছুঁতে হয়। ক'জন আমরা সে চেষ্টা করি বলুন।
সেদিন কী আর জানতাম যে আপনি আমারই ঠিকানায় চিঠি পোস্ট করতে যাচ্ছেন। দেখুন তো কী যোগাযোগ। কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় বলুন। আসলে কী জানেন এই গরমে সমীরণ যদি সুশীতল হয় তবে কী ভালো বলুন।
সাধ করে কী আর সেদিন বলেছিলাম ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। যাক চা-টা খেয়ে পঞ্জিকা দেখে আচার ব্যবস্থা দিনক্ষণ ঠিক করে ফেলুন! আপনার মেয়েকে আমি পুত্রবধূ হিসেবে দাবি করছি। এখন নিশ্চয় আর রাগ করবেন না, বলুন।” ধর্মের কল বাতাসে নড়ে, ধর্মের কল বাতাসে নড়ে, ধর্মের কল বাতাসে নড়ে, ধর্মের কল বাতাসে নড়ে,