ফেইসবুকে আমাদের সকল আপডেট পেতে Follow বাটনে ক্লিক করুন।
কিশোর গল্প : আক্কেল সেলামি | Kishor Golpo : Akkel Selami

খবরের কাগজ পড়তে-পড়তেই বাঁ-হাত দিয়ে জানলার পর্দাটা একটু তুলে বাইরেটা দেখে নিলেন স্মৃতিময়বাবু। বেশ ঝকঝকে রোদ উঠেছে। মনটা ফুরফুরে লাগছে। কাগজ থেকে মুখ না তুলেই কথাটা হাওয়ায় ভাসিয়ে দিলেন—কই গো, বাজারের থলেটা দাও; সাড়ে দশটা বেজে গেল।
এর পরে বাজারে গেলে আর কিছু পাব ভেবেছ? ইস! বড্ড দেরি হয়ে গেল। খবরের কাগজটাও পড়া হল না ভালো করে। কত খবর, পড়ে শেষ করা যায় না। বুঝলে গিন্নি, হেতমপুরে ডাইনি অপবাদে এক মহিলাকে গ্রামবাসীরা পিটিয়ে মেরেছে।
এম. আই. এস-এর টেন পার্সেন্ট বোনাসটা তুলে দিল। লোকে আর টাকাপয়সা রাখবে কোথায়!...কই গো, কোথায় গেলে গো! কী অত সকাল থেকে রান্নাঘরে টুকুস-টাকুস খুটুর খুটুর করছ, সামনে এসে বোসো না দু-দণ্ড। রোববারের সকাল বলে কথা।
অন্য দিন তো ঘুম ভাঙতে না ভাঙতেই পায়ে ঢাকা লাগিয়ে গাড়ি গিয়ারে ফেলে দিতে হয়। তোমারও তাড়া থাকে, আমারও দাঁতে ব্রাশ লাগাবার সময় থাকে না।....এই যে কাল শহর জুড়ে গ্রেগ চ্যাপেলের পুশকুত্তলিকা, থুড়ি কুশপুত্তলিকা, পোড়াল ওরা, তাতে কি ওই লালমুখো সাহেবের কিছু এল গেল, না তিনি বোঁচকা-বেডিং নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় চম্পট দিলেন?
বুঝলে প্রতিমা, ভালো খবর একটাও নেই। না-না, ভুল বললাম। তোমার জন্যে অন্তত একটা সুখের খবর আছে। বি এস এন এল এসটিডি আর লোকাল দুটোরই রেট কমিয়েছে। তোমার সুদিন এবার এসে গেল। চুটিয়ে বাপের বাড়ির সঙ্গে খোসগল্পের টক-টাইম বাড়াতে পারবে।
অনেকক্ষণ ধরেই রান্নাঘর থেকে বাসনের ঝনঝনানি আর কাপডিশের টুংটাং আওয়াজ আসছিল। তার সঙ্গে কলের থেকে ফুল স্পিডে জল পড়ার তুমুল শব্দ। সেদিকে হুঁশই নেই স্মৃতিময়বাবুর। আসলে সংসারের খুঁটিনাটি বিষয়ে তাঁর মনোযোগ বড়ো কম।
তাঁর অবিশ্যি দোষ-টোষও বিশেষ নেই। প্রথম দিকে চেষ্টাও করেছিলেন অনেক। কিছুতেই কিছু হয়নি। একদিন ভাবলেন আজ দুটো ভাতেভাত রেঁধে গিন্নির গোমড়া মুখে হাসি ফোটাবেন।
কপাল মন্দ হলে যা হয় আর কী। ভাত চাপিয়ে দিয়ে খবর শুনবেন বলে টিভিটা চালিয়ে সোফায় বসলেন, ব্যস দফারফা। ওপর থেকে প্রতিমার হেঁড়ে গলার পরিত্রাহি চিৎকার—নাকে কি তুলো গুঁজেছ, না কি কাকভোরে জরদা দেওয়া বেনারসি পান মুখে ঠুসে বসে আছ?
ভাত যে পুড়ে ঝামা হয়ে গেল সেদিকে খেয়াল নেই? পোড়া গন্ধে তো পাড়ার লোকের অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে আসার জোগাড়।
বলি কে তোমার মাথায় দিব্যি দিয়েছিল সাতসকালে সংসারের এই উপকারটা করার জন্য। যত বয়স বাড়ছে তত বুদ্ধি-সুদ্ধি লোপ পাচ্ছে।
স্মৃতিময়বাবু বুঝলেন কাজটা বড়ো আহাম্মকি হয়ে গেছে। সে যাত্রা দুঃখ-টুঃখ প্রকাশ করে হাসিমুখে পোড়া হাঁড়ি মাজতে বসে গিয়েছিলেন। আর একদিন মাছের ঝোল রাঁধতে গিয়ে স্বাদ বাড়বে ভেবে খানিকটা হিং আর জাফরান দিয়ে দিয়েছিলেন।
এছাড়া চা করতে গিয়ে চিনির বদলে নুন দিয়ে কতদিন যে বউয়ের মুখ ঝামটা খেয়েছেন তার কোনো হিসেব নেই। এখন আর বড়ো একটা রান্নাঘরের ধারকাছ মাড়ান না।
স্মৃতিময়বাবু দেয়ালঘড়ির দিকে তাকালেন বাঁকা চোখে। পৌনে এগারোটা। চঞ্চলতা প্রকাশ পেল, নাঃ আজ কপালে আবার গিন্নির মুখনাড়া আছে। গলার স্বরটাকে যতদূর সম্ভব মোলায়েম করে বললেন—বাজারের থলেটা কী ইঁদুরের পেটে চলে গেল নাকি?
দিতে এত দেরি করছ কেন? আর হ্যাঁ, দেরি যখন হয়েই গেল, তখন আর এক কাপ চা দিয়ে দাও। খেয়েই যাই। সকালের চা-টা খেয়ে ঠিক মেজাজ এল না।
মুখের কথা শেষ হওয়ার আগেই পরপর দুটো বিস্ফোরণের শব্দ। গিন্নির মেজাজের সুখ্যাতি ভালোমতোই জানা আছে স্মৃতিময়বাবুর। হবে নাই বা কেন। আটাশ বছরের আনইন্টারাপ্টেড সহাবস্থান। কত সাইক্লোন টাইফুন সুনামি সামলে এখনও ব্যাটিং করে যাচ্ছেন।
স্মৃতিময়বাবু আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। বিস্ফোরণের শব্দে তাঁর সব কথা চাপা পড়ে গেল।
—দাঁড়াও দাঁড়াও। বাজারের থলে আর চা-চা করে মুখে ফেনা তুলে ফেললে। কাজ না থাকলে রাস্তায় গিয়ে পাড়ার জঞ্জাল পরিষ্কার করো কোদাল বেলচা নিয়ে। সমাজসেবা হবে।
লোকে বাহবা দেবে। আমাকে জ্বালিও না।....তোমার আর কী, ফুর্তির প্রাণ গড়ের মাঠ। মালতীর মা যে আজ আসেনি সে খেয়াল আছে? এইমাত্র বাসনের ডাই মেজে উঠলাম। এখন চা-ফা হবে না। পালের দোকান খোলা আছে, গিলে নিও। আমাকে না বকিয়ে বাজারটা করে আমাকে উদ্ধার করো।
আর হ্যাঁ, আজ আর জলখাবারের জন্যে আটার তাল মাখতে ইচ্ছে করছে না। বাজার করে আসার সময় শিঙাড়া জিলিপি নিয়ে এসো যদি গরম পাও। না হলে ম্যাগিও আনতে পারো।
ঠিক তিন মিনিট পরে দ্বিতীয় বিস্ফোরণ। আঁচলে হাত মুছতে মুছতে গিন্নি এসে দাঁড়ালেন সোফার কাছে—এ কী! চা তো ঠান্ডা জল হয়ে গেল। অর্ধেক খেয়ে আর খাওনি দেখছি। তোমার মতো ভুলো লোককে নিয়ে আর চলে না। দয়া করে আমাকে এবার রেহাই দাও।
স্মৃতিময়বাবু চমকে উঠলেন। একেবারে রেঞ্জের মধ্যে গিন্নি। খবরের কাগজটা সরিয়ে রাখতে গিয়ে আর এক বিপত্তি। আসলে চায়ে উনি চুমুকই দেননি। ভুলে গেছেন। কাগজের নীচের দিকটা এতক্ষণ চায়ের কাপে লুটোপুটি খাচ্ছিল। কাপের অর্ধেক চা যে কাগজের পেটে গেছে সেটা এতক্ষণে বুঝলেন।
মনে-মনে বেশ লজ্জিতও হলেন। আমতা-আমতা করে দু-বার সরি বলে আড়মোড়া ভেঙে উঠে পড়লেন। নিজেই রান্নাঘরে গিয়ে দরজার পেছনের হুক থেকে বাজারের থলে দুখানা নিয়ে চটি গলিয়ে বেরিয়ে পড়লেন।
রাস্তায় বেরিয়ে দুশো গজ পথ গেছেন কী যাননি, আবার এক ফ্যাসাদ। কে যেন পেছন থেকে উচ্চৈঃস্বরে তাঁর নাম ধরে ডেকে চলেছেন—স্মৃতিময়বাবু ও স্মৃতিময়বাবু, একটু দাঁড়ান।
প্রথমটায় খেয়াল করেননি। খানিক পরে বুঝলেন। হাজার হলেও পিতৃদত্ত নাম তো, সহজে ভুল হওয়ার নয়। হাঁটার গতি কমিয়ে দিলেন। কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করতেই শুনতে পেলেন, ও স্মৃতিদা শুনুন। করেছেন কী অ্যাঁ!
ততক্ষণে লোকটার নিশ্বাস তাঁর ঘাড়ের কাছে পড়তে শুরু করেছে। স্মৃতিময়বাবু তাকিয়ে দেখলেন পাশের বাড়ির বিশ্বম্ভরবাবু তাঁর পাঞ্জাবি ঘেঁষে দাঁড়িয়ে।
পান খাওয়া দাঁত বের করে মিষ্টি-মিষ্টি হাসছেন---বাব্বা! কী বেখেয়ালে লোক আপনি, অ্যাঁ! কখন থেকে পেছন-পেছন আসছি, মানে দৌড়চ্ছি, আর হেঁকে-হেঁকে ডাকছি। আপনার হাঁটার যা
স্মৃতিময়বাবু খুব একটা আমল দিতে চাইলেন না। লোকটাকে উনি বিলক্ষণ চেনেন। এক নম্বর বকবকমবাজ। পারতপক্ষে কথা বলতে চান না। তবু ভদ্রতার খাতিরে কিছু বলতে হয় ভেবে চলতে-চলতেই বললেন,
– অঁ, তাই বুঝি। ডাকছিলেন? একটু তাড়া ছিল আর কী। তা বলুন, যা বলার বলে ফেলুন। –না, মানে, তাড়া যে আছে বোঝাই যাচ্ছে।
—কী করে বুঝলেন? হাত-ফাত, থুড়ি পিঠ-ফিঠ দেখতে জানেন নাকি? –না, মানে পা ।
—তার মানে? তামাশা করছেন ?
—কী যে বলেন দাদা। আপনার সঙ্গে তামাশা করব সে ধৃষ্টতা আমার আছে? স্মৃতিময়বাবু ভুরু তুলে বললেন, – বাজার করতে হবে। এর পর বাজারে গেলে মাছের আঁশ আর নাড়িভুঁড়ি নিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে। বলি আমার বকুনিটা কি আপনি খাবেন? —তা যা বলেছেন।
আমারও একই অবস্থা। সকাল থেকে রাত অব্দি ওই আপনার মতোই বকুনি। শুধু বকুনি আর বকুনি। মুখঝামটা খেতে-খেতে দেখুন না কত রোগা হয়ে গেছি। আপনি তো তবু, যাক বলতে নেই, আজ আপনার জন্মবার-টন্মবার নয় তো, মানে তেলে জলে আছেন। আমার অবস্থাটা দেখুন, হাত-পায়ের শিরাগুলো যেন শুকনো ছোলাশাক ।
স্মৃতিময়বাবু এবার বেশ বিরক্ত হলেন। তবু যথাসম্ভব ভদ্রতা বজায় রাখার চেষ্টা করে বললেন—আরে মশাই, বেশ লোক আপনি! বলছি তাড়া আছে। তখন থেকে একই কথা হাজিয়ে যাচ্ছেন। যা বলার চটপট খোলসা করে বলে ফেললেই তো হয়। তখন থেকে গৌরচন্দ্রিকা করছেন কেন?
শব্দটা ঠিক বুঝলাম না, মুখ্যু মানুষ। আপনার কাছে আমি, মানে যাকে বলে হিরে আর জিরে। ইংরেজি শব্দ না ফারসি? আগে কারও মুখে শুনিনি তো তাই বললাম। কথাটার অর্থ যদি বুঝিয়ে বলতেন। আচ্ছা আজ না হয় থাক। তাড়া আছে বলছিলেন।
স্মৃতিময়বাবু এবারে আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারলেন না। মেজাজ হারিয়ে ফেললেন। বেশ বিরক্তির সঙ্গে ঝাঁঝিয়ে বলে উঠলেন— ধুর মশাই এখন যান তো। কানের পোকা নড়িয়ে দিলেন। এইজন্যেই পাড়ায় আপনাকে কেউ পছন্দ করে না।
লোকটা দুই কানে হাত দিয়ে, গদগদ ভাব করে, চোখে-মুখে বেশ ভক্তি-টক্তি এনে বললেন—বলছিলাম কী, যাকগে না হয় থাক, বলে কাজ নেই। কীসের থেকে কী হয়ে যাবে। বলতেও সংকোচ হয়। আপনার মতো মানুষের নজর সব সময় ওপরের দিকে থাকে।
আমার মতো চশমখোর তো আপনি নন। বেরোবার সময় তাড়াহুড়োতে ওরকম একটু আধটু মিসটেক হতেই পারে। আর তা ছাড়া চটির দিকে কজনই বা খেয়াল করে বলুন।
নেহাত আমি বিয়েবাড়ি টিয়েবাড়িতে পুরোনো চটি পালটে নতুন চটি হাতিয়ে, সরি পাতিয়ে নেওয়ার ধান্দায় থাকি বলেই চটির দিকে নজর রাখি । বলি ডান পায়ের চটিটা কি বউদিঠাকরুনের?
স্মৃতিময়বাবুর হুঁশ ছিল না। নিজের মনেই ডবল স্পিডে হেঁটে যাচ্ছিলেন। লোকটার শেষ কথাটা কানে যেতেই চমকে উঠে পায়ের দিকে তাকালেন। সত্যিই তো দু পায়ে দুরকম চটি। একপাটি নিজের, আর এক পাটি গিন্নির। এতক্ষণে খেয়াল হল কেন ওরকম অস্বস্তি হচ্ছিল।
আমতা আমতা করে বললেন, আরে মশাই, কীরকম লোক আপনি! গৌরচন্দ্রিকা না করে আরও আগেই বলতে পারতেন। যাকগে, বাজার এসে গেছে। আপনি এবার আসতে পারেন। আমি না হয় বাড়ি ফেরার সময় একটা রিকশা নিয়ে নেষ।
সত্যিসত্যিই বাজারের কাছে এসে পড়েছিলেন দুজনে। স্মৃতিময়বাবু চারপাশটা দেখে নিয়ে পা থেকে চটিজোড়া খুলে মাছের ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে নিলেন। তারপর একটা ডিঙি মেরে বাজারের গলিতে ঢুকে পড়লেন। সঙ্গের লোকটি বেগতিক দেখে পিঠটান দিল।
শেষবেলার বাজার। ভালো জিনিস কিছু নেই বললেই হয়। নেহাত রবিবার বলেই দু-চারটে সবজিওলা তখনও ছিল। চটপট করে কিছু ডাঁটা মুলো-শিম-বেগুন নিয়ে এগোলেন 'মাছের গলির মধ্যে।
পচা মাছ কিনে-কিনে গিন্নির কাছে বকুনি খেয়ে ইদানীং দু একটা বাঁধা মাছওলা পছন্দ করে রেখেছেন। ভাবলেন গঙ্গার কাছ থেকে কিছু কুঁচোকাঁচা মাছ নেবেন।
রোববার দিন শেষ পাতে একটু পুঁটি-মৌরলার টকঝোল খারাপ লাগে না। গিন্নিরও খুব পছন্দ। নিলে খুশিই হবে।
কাছে গিয়ে মুখটা কাঁচুমাচু করে দাঁড়াতেই গঙ্গা জিজ্ঞেস করল –কে গেল, দাদা? স্মৃতিময়বাবু চমকালেন—কে গেল মানে? কে আবার কোথায় যাবে? মৌরলা কত করে দিচ্ছিস। পচা হবে না তো?
—মানে, বাবা না মা?
স্মৃতিময়বাবু ঠিক বুঝতে পারলেন না। খুব যে একটা বোঝার চেষ্টা করলেন সেরকম ভাবও ফুটে উঠল না।
—তা কত বয়স হয়েছিল? আশি পেরিয়েছিল? ভুগলেন টুগলেন? তাই দেখিনি ক'দিন বাজারে। দাড়ি আর খালি পা দেখেই বুঝেছি। যা হোক, মৎস্যমুখের মাছটা বাবু আমার এখেন থেকেই নেবেন। দামের জন্যে চিন্তা করবেন না।
স্মৃতিময়বাবু বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন – সাতসকালে গাঁজাফাজা টেনেছিস নাকি? কী বলতে চাস? —বলি দাম কি কোনোদিন বেশি নিয়েচি আপনার থেকে? সে আপনি ভাববেন
না....গুরুদশা নিয়ে মাছবাজারে এলেন কেন, আমাকে খবর পাঠালেই চলে আসতাম। স্মৃতিময়বাবু যেন কিছুরই তাল খুঁজে পাচ্ছেন না। মনের ভেতর হাপরের ওঠানামা। চাইলাম মাছ, আর ও ব্যাটা মৎস্যমুখ গুরুদশা তখন থেকে কী সব প্রলাপ বকে চলেছে।
ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠলেন,—আরে মশাই, তালকানা নাকি? দিলেন তো পা টা মাড়িয়ে। চোখের মাথা খেয়ে বসে আছেন নাকি? উঃ! পুরো পাতাটার নুনছাল উঠিয়ে দিলেন।
—সরি দাদা, দেখতে পাইনি। এক্সট্রিমলি সরি। আক্কেল সেলামি
সরি বললেই সাত খুন মাপ হয়ে গেল? আমার পায়ের ব্যথাটা কি আপনি সারিয়ে দেবেন? বুটজুতো পরে কেউ বাজারে আসে। লোকটি মোলায়েম কন্ঠস্বরে বলল—আপনিই বা ভিড়ের মধ্যে খালি পায়ে বাজারে
এসেছেন কেন ?
স্মৃতিময়বাবু বিষম খেলেন। খালি পা, মুখে চার পাঁচ দিনের দাড়ি, গায়ে চাদর জড়ানো, ধুতিটাও কোরা, বেরোবার সময় চুলে চিরুনি দেওয়ার কথাও খেয়াল হয়নি— গঙ্গার আর অপরাধ কী? অশৌচ-অশৌচ ভাব তো বিলক্ষণ ফুটে আছে।
নিজের অপরিণামদর্শিতার জন্যে মনে-মনে পরিতাপও হচ্ছিল খুব। এ যাত্রায় মাছ কেনার আশা ত্যাগ করলেন। কপালে বউয়ের মুখনানা থাকলে খণ্ডাবে কে? আক্কেল সেলামি
গঙ্গার কাছ থেকে বিদেয় নিয়ে চলে এলেন ডিমের দোকানে। নিদেন কিছু ডিম নিয়ে ঘরে না ঢুকলে রেহাই নেই। বিয়ের পর থেকেই দেখে আসছেন গিন্নি নিরামিষ একদম খেতে পারে না।
বাড়ি ফিরে গিন্নির বাউন্সারগুলো কীভাবে ফেস করবেন, হুক করবেন না ডাক করবেন, তাই ভাবতে ভাবতে বাজারের গলি থেকে বেরোলেন। আবার কবে বাজারে আসতে পারবেন সেই আশঙ্কায় ছ'টা পোলট্রির ডিম আর কেজি পাঁচেক আলু পিঁয়াজও কিনে নিলেন।
ব্যাগের ওজনটা ভালোই হল। তার ওপর রাস্তায় ইটের খোয়া ফেলেছে। পায়ে যেন ছুঁচ ফুটছে। ব্যাগের ভারে একদিকের কাঁধ ঝুলে গেছে। হাত পালটে-পালটে কোনো রকমে রিকশাস্ট্যান্ডের কাছাকাছি এলেন।
—স্যার, দিন-দিন, আমাকে দিন ব্যাগদুটো। আমি থাকতে আপনি ব্যাগ বইবেন এটা কি ভালো দেখায় বলুন। আমি বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছি। আপনি বরং একটা রিকশা নিয়ে চলে যান। অ্যাই বিরিঞ্জি, বাবুকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আয়। সাবধানে চালাবি, যেন একটুও জার্কিন না লাগে।
স্মৃতিময় হকচকিয়ে গেলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় একটু ঘাবড়ে গেলেন। তবে মুখে প্রকাশ করলেন না। পাশে পাশে হাঁটছিল বলে আগে ভালো করে খেয়াল করেননি। আলগোছে দেখে তখন মনে হয়েছিল পাড়ার বিপিনের তেলেভাজার দোকানে সর্বক্ষণ বসে থাকা বখাটে ন্যাড়াটা।
এখন সামনাসামনি দেখে ন্যাড়া বলে মনে হল না। ন্যাড়ার চেহারার সঙ্গে অবশ্য বিস্তর মিল আছে। কেমন যেন ধন্ধে পড়ে গেলেন স্মৃতিময়বাবু। কী করবেন ভেবে ওঠার আগেই একরকম টেনে হিঁচড়ে ব্যাগদুটোর দখল নিয়ে নিয়েছে ছেলেটা। আক্কেল সেলামি
স্মৃতিময়বাবু দুবার ঢোঁক গিলে আমতা-আমতা করে বললেন, – তুমিই একটু আগে মাছবাজারে গলির মধ্যে আমার পেছন-পেছন আসছিলে না? তোমার নাম ন্যাড়া তো? বিপিনের দোকানে থাকা হয় না?
ছেলেটা অমায়িক হাসি হেসে বলল -কী পচা গরম পড়েছে বলুন। রাস্তায় খোয়া ফেলার আর সময় পেল না। চাল-টাল কিনলেন বোধ হয়। ভালোই করেছেন।
এ কী! পায়ের পাতাটা তো চটকানো ছানার জিলিপি করে দিয়েছে। আপনি কিছু বললেন না? ছেড়ে দিলেন? নিন, রিকশা এসে গেছে। উঠে পড়ুন। সাবধানে। পায়ে যেন চাড় না লাগে। আক্কেল সেলামি
স্মৃতিময়বাবু আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। বিরক্তি ফুটিয়ে বললেন, – তোমাকে তো ঠিক চিনলাম না। তুমি ন্যাড়া নও তো! তোমার নাম কী? যেচে আমাকে সাহায্য করতে এসেছ কেন? চেনো আমাকে? আমার হেলপ্ লাগবে না। তুমি আসতে পারো। আমি তোমাকে চিনি না।
—দেখুন স্মৃতিদা, না চেনাটা, নাম না জানাটা কোনো বড়ো ব্যাপার নয়। এখন নাম জানেন না, জানতে কতক্ষণ ? ন্যাড়াকে তো চেনেন। তাতেই হবে। আমি ন্যাড়ার ছোটো ভাই। আমাকে আপনি চেনেন না, কিন্তু আমি আপনাকে ভালোই চিনি। আপনার মতো মানুষ লাখে তিনটে মেলে। নিন উঠুন।
–থাক-থাক, কোনো দরকার নেই। যেচে উপকার করা খারাপ, জানো তো? দাও, ব্যাগদুটো দাও সাবধানে। ঝাঁকিয়ো না। ডিম আছে। –ঠিক আছে। আপনি উঠুন, আমি ব্যাগদুটো আপনার পায়ের মাঝখানে রেখে দিচ্ছি। একটা কথা বলব স্যার?
—আবার কী কথা? তোমার তো দেখছি কথার আর সীমা পরিসীমা নেই। –বলছিলাম কী দাদা, বউদিঠাকরুণ বললেন বাড়িতে চা পাতা, পোস্ত আর সরষের তেল বাড়ন্ত। আপনাকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে বলতে বলেছেন। তা আপনার পায়ের আবার এই অবস্থা। আবার নামবেন, আবার উঠে—।
—তোমার সঙ্গে বউদির কোথায় দেখা হল? ইয়ার্কি মারার জায়গা পাওনি? আমার বাড়ি কোথায় বলো তো?
—লজ্জা দেবেন না স্যার। আপনার মতো মহামান্য লোকের বাড়ি না চিনে থাকা যায়? আটচালার বাঁদিকে পুকুরটার পরেই তো আপনার বাড়ি। হলুদ রঙের দেওয়াল, সাদা গ্রিল দেওয়া গেট, উঠোনে গাঁদা আর চন্দ্রমল্লিকার ঝাড়। আক্কেল সেলামি
ঠিক বলছি কিনা বলুন। তা আপনি আবার কষ্ট করে নামবেন কেন, আমাকে টাকা দিন, এনে দিচ্ছি। আপনার জন্যে কিছু করতে বড়ো মন চায়। আপনি রিকশায় বসে থাকুন। এই পা নিয়ে আবার খোয়ার মধ্যে যেতে হবে না। আক্কেল সেলামি
স্মৃতিময়বাবু যেন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যাচ্ছেন। নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন – তুমি আমার বাড়িতে কী করতে গেসলে ?
—আর বলবেন না। বাজারে আপনাকে খালি পায়ে ঘুরতে দেখে ভাবলাম বউদি- ঠাকরুনের কাছ থেকে আপনার ভালো জুতোজোড়াটা চে' আনি। তা বউদিঠাকরুনের দেখলাম আপনার ওপর বিস্তর ক্রোধ। বললেন কী—না থাক, আপনার শুনে কাজ নেই । – না, না বলো। বলে ফেলো। আমার জানা দরকার।
বললেন কী, বুড়ো মরুকগে। খালি পায়ে হেঁটে দেখুক কেমন লাগে। বুড়োর ভিমরতি হয়েছে। স্যার, আর বলা যাবে না। আপনি শুনলে দুঃখ পাবেন। আক্কেল সেলামি
দুঃখ! ছোঃ! তুমি খেপেছ? স্মৃতিময় পাকড়াশিকে টাইট দেওয়া অত সোজা নয়। এই নাও একশোটা টাকা রাখো। জিনিসগুলো কিনে নিয়ে এসো। আমি চললাম। একটা হেস্তনেস্ত করা দরকার। এই বিরিঞ্চি, চালা তো দেখি স্পিডে। আক্কেল সেলামি
বাড়ি গেটে পৌঁছতেই স্মৃতিময় প্রায় ভিরমি খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলেন। -বলি তোমার আক্কেলটা কী শুনি। দু-ঘণ্টা ধরে কী করছিলে? বাজারশুদ্ধ তুলে এনেছ নাকি? আবার অচেনা অজানা একটা লোককে দিয়ে জুতো চেয়ে পাঠানো হয়েছে! তা জুতোজোড়া করলে কী?
এখনও তো দেখছি খালি পায়ে। আর কী ভুলো মনরে বাবা। বাজার যাওয়ার সময় পয়সা নিয়ে যেতে কেউ ভুলে যায়, তা এই তোমাকেই দেখলাম। লোকটাকে তো কস্মিনকালেও দেখেনি।
ওর হাতে দুশো টাকা দিতে ভরসা হচ্ছিল না। তা লোকটা দেখলাম ভালোই চেনে। তোমার কাছে পড়েছে বলল । তা ছাড়া বলল—।
—তোমার কি মাথা-টাথা খারাপ হয়েছে, না কি? আমি টাকা চেয়ে পাঠাব কেন? টাকা তো আমি নিয়েই গেছি। তা ছাড়া জুতো আমি পরেই গিয়েছিলাম। তবে ভুল করে আমার একপাটি আর তোমার একপাটি পরে ফেলেছিলাম।
এইটুকুন তো রাস্তা। সে তো রিকশা করেই আসা যায়। বরং তুমিই তো ভুলোরাম। চা-পাতা, সরষের তেল আর পোস্ত আনার কথা ভুলে মেরে দিয়েছ। তার জন্যেই তো দেরি হল। তা আমি ওকে, যাচ্চলে নামটাও জিজ্ঞেস করা হল না, একশোটা টাকা দিয়েছি। আক্কেল সেলামি
এক্ষুনি আনছে। এই নাও, ব্যাগদুটো ধরো। আজ মাছ পাইনি। ডিমের ঝোল-ভাতই করো। —তুমি কি বাজারে গিয়ে নেশাটেশা করে এসেছ নাকি? পরশুদিন মাসকাবারের মুদিখানা বাজার করে আনলে নিজের হাতে। আজ আবার পোস্ত তেল চা লাগবে কী জন্যে শুনি।
একবারও কি তোমার মাথায় এল না এই সামান্য কথাটা? মহা ফেরেপ- বাজের পাল্লায় পড়েছ তুমি। ও আর এসেছে। তোমার একশোটা টাকাই জলে গেল। —আর তুমিই বা কী শুনি। নাম-না-ধাম না জেনেই নতুন জুতোজোড়াটা আর দুশো টাকা দিয়ে দিলে?
বুদ্ধিশুদ্ধি তোমারই বা কবে হবে শুনি। শুধু আমার ভুল ধরে গেলে হবে? যাকগে যা হওয়ার হয়ে গেছে। অনেক শিক্ষা হল। দুজনেরই আক্কেল সেলামি দেওয়ার দরকার ছিল। পঞ্চতন্ত্রে আছে না 'অজ্ঞাতকুলশীলস্য বাসো দেয়ো ন কস্যচিৎ'। পরীক্ষায় খুব কারক-বিভক্তি লিখতে দিত।
—অতশত বুঝি না বাপু। তবে ভুল আমারও হয়েছে। সকালে তোমার ওপর চোটপাট করাটা ঠিক হয়নি।
—ঠিক আছে মাপ করে দিলাম। তবে ন্যাড়ার ভাই যখন বলেছে তখন ওর নাম নিশ্চয়ই গ্যাড়া হবে। কোনো সন্দেহ নেই। না হলে দুদিক থেকে গ্যাঁড়াবেই বা কেন। এবার পাড়ার ক্লাবকে বলে ওকে একটা গ্র্যান্ড সংবর্ধনা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে বুঝলে। আক্কেল সেলামি, আক্কেল সেলামি
—আর তুমি সেই অনুষ্ঠানের সভাপতি হবে। Akkel Salami, Akkel Salami, Akkel Salami, Akkel Salami, Akkel Salami