সরকার ও রাজনৈতিক দল: ধারণা, সম্পর্ক ও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রায় একই ধরনের দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তিগণ নির্দিষ্ট কিছু কর্মসূচির ভিত্তিতে যখন মিলিত হয় বা একত্রিত হয়, তখন তাকেরাজনৈতিক দলবলে। এটি একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রাণশক্তি হিসেবে কাজ করে।
সরকার ও রাজনৈতিক দল: ধারণা, সম্পর্ক ও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রায় একই ধরনের দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তিগণ নির্দিষ্ট কিছু কর্মসূচির ভিত্তিতে যখন মিলিত হয় বা একত্রিত হয়, তখন তাকেরাজনৈতিক দলবলে। এটি একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রাণশক্তি হিসেবে কাজ করে।
.webp)
অপরদিকে, দলের মধ্যেই যখন কিছু কিছু সদস্য দলীয় নীতি ও কর্মসূচির বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে দ্বিমত পোষণ করে কিংবা সাধারণ স্বার্থের কথা ভুলে গিয়ে ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারে ঐক্যবদ্ধ হয়, তখন তাকেউপদল বা কুচক্রী দলবলা হয়। একটি সুশৃঙ্খল রাজনৈতিক ব্যবস্থায় উপদলের উপস্থিতি দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল নির্দেশ করে।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিরোধী দলের ভূমিকা
আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিরোধী দল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রত্যেকটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে একাধিক রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব লক্ষণীয়। জাতীয় নির্বাচন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে, সেই দলই সরকার গঠন করে। আর যে দল দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে, সেই দল বিরোধী দল হিসেবে পরিচিত হয়।
মূলত সরকারি দলের বাইরে যেসব রাজনৈতিক দল প্রতিনিধিত্ব করে তাদেরই বিরোধী দল হিসেবে অভিহিত করা হয়।পেঙ্গুইন অভিধান (Dictionary of politics, p. 243)-এর মতে:
বিরোধী দলের গুরুত্ব সম্পর্কেআইভর জেনিংস (Ivor Jennings)বলেছেন,
এইচ আগার (H Agar)বলেছেন,
প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় বিরোধী দলকে 'বিকল্প সরকার' হিসেবেও গণ্য করা হয়।
সরকার: রাষ্ট্রের অপরিহার্য উপাদান
রাষ্ট্রের অপরিহার্য তৃতীয় উপাদানটি হলো সরকার। একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের জনসমষ্টিকে নিয়মনীতির মধ্যে পরিচালনার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোই হলো সরকার, যা রাষ্ট্রের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করে। সরকার গঠনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগের সমন্বয়ে সরকার গঠিত হয়। সরকারের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়েঅধ্যাপক গার্নারবলেন,
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সাধারণত নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ তাদের সরকার গঠন করে।
দল ও সরকারের মধ্যে সম্পর্ক
বর্তমানে প্রায় অধিকাংশ রাষ্ট্রে দলীয় ব্যবস্থা বিদ্যমান। তাই বলা যায়, দল ও সরকারের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। সহজ কথায় দল হলো একই মতাদর্শের ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত একটি সংগঠন, যারা সংঘবদ্ধভাবে সরকারি ক্ষমতা দখলের চেষ্টায় রত থাকে।
জোসেফ শুম্পিটার (Joseph Schumpeter)বলেছেন,
সরকার ও রাষ্ট্রের মধ্যে পার্থক্য
অনেক সময় রাষ্ট্র ও সরকারকে সমার্থক মনে করা হলেও এদের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান। নিচে একটি তুলনামূলক ছক দেওয়া হলো:
| রাষ্ট্র | সরকার |
|---|---|
| রাষ্ট্র একটি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সংগঠন। | সরকার রাষ্ট্রের মুখপাত্র মাত্র। |
| রাষ্ট্রের অংশ তিনটি- আইন, শাসন ও বিচার বিভাগ নিয়ে গঠিত নয়, বরং রাষ্ট্র একটি বিমূর্ত ধারণা। | সরকার এই তিনটি বিভাগের (আইন, শাসন, বিচার) সমন্বয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করে। |
| রাষ্ট্র ধারণামাত্র। একে অনুভব করা গেলেও দেখা যায় না। | সরকার দৃশ্যমান প্রতিষ্ঠান। |
| রাষ্ট্র স্থায়ী প্রতিষ্ঠান। | সরকার অস্থায়ী এবং পরিবর্তনশীল। |
| সার্বভৌমত্ব রাষ্ট্রের চূড়ান্ত ক্ষমতা। | সরকারের নিজস্ব সার্বভৌমত্ব ক্ষমতা নেই, এটি রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগ করে মাত্র। |
| রাষ্ট্র ভৌগোলিক প্রতিষ্ঠান এবং নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে এর অবস্থান। | সরকারের সঙ্গে নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই, এটি পরিচালনার মাধ্যম। |
রাজনৈতিক দল ব্যবস্থা ও শ্রেণিবিভাগ
আধুনিক বিশ্বের সকল রাষ্ট্রে দলীয় ব্যবস্থা বিদ্যমান। সংখ্যার ভিত্তিতে দলীয় ব্যবস্থাকে প্রধানত তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়। বিষয়টি নিচের ডায়াগ্রামে দেখানো হলো:
ব্যবস্থা
ব্যবস্থা
ব্যবস্থা
১. একদলীয় ব্যবস্থা:দেশে একটি মাত্র রাজনৈতিক দল থাকলে তাকে একদলীয় ব্যবস্থা বলে।
২. দ্বিদলীয় ব্যবস্থা:দেশে দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল থাকলে তাকে দ্বিদলীয় ব্যবস্থা বলে।
৩. বহুদলীয় ব্যবস্থা:দেশে দুটির বেশি রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব ও প্রাধান্য থাকলে তাকে বহুদলীয় ব্যবস্থা বলে। বাংলাদেশে বহুদলীয় ব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক জোট ও এর প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশে বিপুল সংখ্যক রাজনৈতিক দল রয়েছে (বর্তমানে নিবন্ধিত দলের সংখ্যা ৩৯টি)। বিভিন্ন নীতি, আদর্শ ও কর্মসূচির ওপর ভিত্তি করে এই দলগুলো গড়ে উঠেছে। অনেক সময় বিভিন্ন মত ও পথের অনুসারী দলগুলো দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সহায়ক শক্তি না হয়ে প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে, তবুও রাজনৈতিক প্রয়োজনে জোট গঠন একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।
ঐতিহাসিক রাজনৈতিক জোটসমূহ
ভারতীয় উপমহাদেশ ও বাংলাদেশে রাজনৈতিক জোট গঠনের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে:
- লক্ষ্ণৌ চুক্তি (১৯১৬):কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে ঐক্য জোরদার করার জন্য।
- বেঙ্গল প্যাক্ট (১৯২৩):চিত্তরঞ্জন দাসের স্বরাজপার্টি ও মুসলমান নেতাদের মধ্যে চুক্তি।
- যুক্তফ্রন্ট (১৯৫৪):ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ বিরোধী জোট।
- সম্মিলিত বিরোধী দল বা COP (১৯৬৫):আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন চাঙা করতে গঠিত হয়।
- পাকিস্তান গণতান্ত্রিক আন্দোলন বা PDM (১৯৬৭):তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন জোরদার করতে।
- গণতান্ত্রিক সংগ্রাম কমিটি বা DAC (১৯৬৯):গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে গঠিত হয়।
- বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি (১৯৭১):স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন রাজনৈতিক জোট।
রাজনৈতিক জোটের বৈশিষ্ট্য
প্রত্যেকটি রাজনৈতিক জোটের কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা তাদের গঠন ও কার্যক্রম পরিচালনা করে:
- বৃহত্তম জাতীয় স্বার্থে রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলা অথবা জাতীয় ক্রান্তিলগ্নে রাজনৈতিক জোট গঠন করা হয়।
- অভিন্ন লক্ষ্য ও দাবি আদায়ের জন্য সংঘবদ্ধ হয়ে আন্দোলন করার জন্য জোটের সৃষ্টি হয়।
- রাজনৈতিক জোট সাধারণত একটি ক্ষণস্থায়ী ব্যবস্থা। সংকট নিরসনের পর জোটভুক্ত দলগুলো আবার তাদের নিজস্ব সত্তা নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে।
- সমমনা কিছু রাজনৈতিক দল সমন্বিত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে ঘিরে জোট গঠন করে।
- যখন কোনো রাজনৈতিক দল এককভাবে কোনো উদ্দেশ্য সাধনে অপারগ হয়, তখন জোট গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।
- জোটবদ্ধ দলগুলো তাদের নিজেদের দলীয় অস্তিত্ব ও নীতি জলাঞ্জলি না দিয়ে একতাবদ্ধভাবে কাজ করে।
If you believe any content on our website infringes your rights, please contact us. We will review and take action promptly.