কৃষি খাতে উন্নয়নে সরকারের পদক্ষেপ
করোনার প্রকোপে যখন জিডিপিতে সর্বোচ্চ অবদান রাখা সেবা খাতসহ অন্যান্য খাতে ধস নেমেছিল, তখন কৃষি খাতই আমাদের রক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। কৃষকরা করোনার ভয়কে অগ্রাহ্য করে আমাদের জন্য খাদ্যপণ্য উৎপাদন করেছিলেন। মূলত তাদের উৎপাদিত খাদ্যপণ্য যেমন: চাল, মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, ডাল, সবজি, ফল ইত্যাদি আমাদের বাঁচিয়ে রাখে।

স্বাধীনতার প্রথম দশকে জিডিপির অর্ধেকের বেশি আসত এ খাত থেকে। কারণ তখন অন্যান্য খাত সেভাবে বিকশিত হয়নি। এখন জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ২০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। জিডিপিতে কৃষি খাতের সরাসরি অবদান কমে গেলেও 'কৃষি আমাদের জাতীয় অর্থনীতির জীবনীশক্তি; দেশের মোট শ্রমশক্তির ৪২ দশমিক ৬২ শতাংশ কৃষিক্ষেত্রে নিয়োজিত'।
বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা ও কৃষিনীতি
বাংলাকে সোনার বাংলায় পুনর্জাগরণের স্বপ্ন ছিল বঙ্গবন্ধুর। তিনি তার লেখা ও বক্তব্যে বিভিন্নভাবে সোনার বাংলার উদ্ধৃতি দিয়েছেন, উল্লেখ করেছেন। এমনকি বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার কয়েক শতাব্দী আগের প্রকৃত সোনার বাংলা পুনঃপ্রতিষ্ঠার চিন্তা করেছিলেন। তিনি জানতেন, একসময় বাংলা শৌর্যবীর্যে পরিপূর্ণ ছিল। '
গোলা ভরা ধান ও পুকুর ভরা মাছ'- এ প্রবাদ বাক্যে নিহিত রয়েছে বাংলার সোনালি যুগের সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যের কাহিনি। বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন, টেকসই কৃষি উৎপাদনের মাধ্যমে এ দেশের অতীত সোনালি গৌরব ফিরিয়ে আনতে পারবেন।
১৯৭১ সালে দেশের জনসংখ্যা ছিল ৭৫ মিলিয়ন। সে সময় খাদ্য ঘাটতি ছিল ২৫-৩০ লাখ টন। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে কৃষির ওপর ব্যাপক গুরুত্বারোপ করেন। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠাই ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন। তিনি সে কারণেই সবুজ বিপ্লবের আহ্বান করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর সবুজ বিপ্লবের স্লোগান ছিল:বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল খাদ্যশস্য উৎপাদনের মাধ্যমে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন এবং জনগণের ন্যূনতম খাদ্য চাহিদা মেটানোর জন্য প্রয়োজনীয় আয় নিশ্চিত করা। প্রথম বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির ৫০০ কোটি টাকার মধ্যে ১০০ কোটি টাকা কৃষিখাতে বরাদ্দ দেন। বঙ্গবন্ধু কৃষি সমৃদ্ধি ও উন্নতির জন্য নিম্নলিখিত প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিষ্ঠা ও পুনর্গঠন করেন:
- বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল
- বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (পুনর্গঠন)
- বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট
- তুলা উন্নয়ন বোর্ড
- উদ্যান উন্নয়ন বোর্ড
- বীজ প্রত্যয়ন সংস্থা
- বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট
- মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন
- বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (কৃষকদের মাঝে সহজ শর্তে ঋণ বিতরণের জন্য)
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কৃষি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জন
সরকারের কৃষিবান্ধব নীতি ও সময়োপযোগী উদ্যোগের কারণে বাংলাদেশ আজ বিশ্বে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে দশম। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অর্জিত সাফল্যসমূহ নিচের ছকে দেওয়া হলো:
| খাত/ফসল | বিশ্বে অবস্থান |
|---|---|
| ধান উৎপাদন | ৩য় (বৃহত্তম) |
| ইলিশ উৎপাদন | ১ম |
| তেলাপিয়া উৎপাদন | ৪র্থ (এশিয়ায় ৩য়) |
| অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মাছ উৎপাদন | ৩য় |
| বদ্ধ জলাশয়ে চাষকৃত মাছ উৎপাদন | ৫ম |
এ পর্যন্ত লবণাক্ততা, খরা, প্লাবনসহিষ্ণু এবং জিঙ্কসমৃদ্ধ ১৩৪টি উচ্চফলনশীল ধানের জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে।
জাতীয় কৃষি নীতি ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
'সমৃদ্ধ কৃষির অগ্রযাত্রায় সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি এবং এসডিজি বাস্তবায়ন' শীর্ষক পরিকল্পনা দলিলে কৃষি, খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনে মোট ৬টি থিমেটিক এরিয়া বা কৌশল চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো নিচে ডায়াগ্রামের মাধ্যমে দেখানো হলো:
৬টি কৌশল
ও উন্নয়ন
উপকরণ
সম্প্রসারণ
ব্যবহার
মোকাবিলা
মানবসম্পদ
কৃষকদের জন্য ডিজিটাল সেবা ও উদ্ভাবন
কৃষিকে আধুনিকায়ন এবং তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর করতে সরকার বেশ কিছু ডিজিটাল পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে:
১. কৃষকের জানালা (Digital System of Plants Problem Identification)
'কৃষকের জানালা' কৃষকদের ফসলের নানা সমস্যার দ্রুত ও কার্যকরভাবে সমাধান দেওয়ার একটি ডিজিটাল প্রয়াস। এখানে ছবি দেখে কৃষক নিজেই তার সমস্যাটি চিহ্নিত করতে পারেন এবং চিহ্নিত ছবিতে ক্লিক করলেই সমস্যার সমাধান মনিটরে ভেসে উঠবে।
- মাঠ ফসল, শাকসবজি, ফলমূল ও অন্যান্য গাছের রোগবালাই, পোকামাকড়, সারের ঘাটতি শনাক্ত করা যায়।
- ১২০ ফসলের ১০০০টিরও বেশি সমস্যার সমাধান রয়েছে।
- প্রতিটি সমস্যার একাধিক ছবি যুক্ত করা হয়েছে যাতে কৃষক সহজেই সমস্যা চিহ্নিত করতে পারে।
২. কৃষকের বাজার
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সার্বিক তত্ত্বাবধানে কীটনাশকমুক্ত শাকসবজির জোগান দিতে যাত্রা শুরু করেছে 'কৃষকের বাজার'। বর্তমানে ৪১টি জেলায় কৃষকের বাজার স্থাপন করা হয়েছে। ফলে কৃষকগণ কৃষিপণ্যের উপযুক্ত মূল্য পাচ্ছে।
৩. তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি
- কৃষি বাতায়ন ও কল সেন্টার: কৃষি কল সেন্টারের ১৬১২৩ নম্বরে যোগাযোগ করে কৃষকগণ সেবা গ্রহণ করতে পারছেন।
- এআইসিসি (AICC): দেশে মোট ৪৯৯টি কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে।
- অ্যাপ ও প্ল্যাটফর্ম: কৃষি কমিউনিটি রেডিও, কৃষক বন্ধু ফোন-৩৩৩১, ই-বুক, অনলাইন সার সুপারিশ, ই-সেচ সেবা, রাইস নলেজ ব্যাংক, কৃষি প্রযুক্তি ভাণ্ডার, ই বালাইনাশক প্রেসক্রিপশন, হর্টেক্স বাজার এবং ফুড ফর নেশন।
কৃষি সহায়তা ও যান্ত্রিকীকরণ
কৃষকের উন্নতির জন্য বর্তমান সরকার কৃষি যন্ত্রপাতি এবং সারের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পরিমাণ ভর্তুকি দিচ্ছে।
- সার ও ঋণ: আন্তর্জাতিক বাজারে সারের মূল্য বৃদ্ধি পেলেও সরকার দেশে সারের দাম বাড়ায়নি। করোনা মোকাবিলায় কৃষি ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশ হতে হ্রাস করে ৪ শতাংশ করা হয়েছে।
- যান্ত্রিকীকরণ: কৃষকদের কৃষিযন্ত্রের ক্রয়মূল্যের উপর ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত সহায়তার মাধ্যমে হ্রাসকৃত মূল্যে কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হচ্ছে।
- সরবরাহকৃত যন্ত্র: ২০১০ থেকে এ পর্যন্ত কম্বাইন্ড হারভেস্টার, রিপার, সিডার, পাওয়ার টিলারসহ প্রায় ৭১,৫০২টি কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হয়েছে। এর ফলে কৃষি শ্রমিকের অপ্রতুলতা মোকাবিলা সম্ভব হয়েছে এবং উৎপাদন ব্যয় কমেছে।
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবে ধরা দিচ্ছে। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে এবং ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হবে। রূপকল্প-২০৪১ এবং বদ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০ এর আলোকে সরকার কৃষির উন্নয়নে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
If you believe any content on our website infringes your rights, please contact us. We will review and take action promptly.