বাংলাদেশের জনসংখ্যা: পরিস্থিতি, বৈশিষ্ট্য ও নৃতাত্ত্বিক পরিচয়
বাংলাদেশে বহু ভাষা, বর্ণ ও গোষ্ঠীর মানুষ বসবাস করে। এদের অরিজিনও বিভিন্ন ধরনের। তাই বাংলাদেশে বসবাসকারী জাতিগোষ্ঠীকে সংকর জাতি বলে অভিহিত করা হয়।

এদেশের মানুষের রক্তে মিশে আছে পৃথিবীর প্রায় সব জনগোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য। তাই বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর নৃতাত্ত্বিক পরিচয় আলোচনার পূর্বে বিশ্ব জনগোষ্ঠী সম্পর্কে আলোচনা করা প্রয়োজন। পৃথিবীর সমগ্র মানবগোষ্ঠীকে প্রধানত ৪টি নরগোষ্ঠীতে বিভক্ত করা হয়।
বিশ্বের প্রধান নরগোষ্ঠীসমূহ
পৃথিবীর প্রধান ৪টি নরগোষ্ঠী এবং তাদের বৈশিষ্ট্য নিচে ডায়াগ্রামের মাধ্যমে দেখানো হলো:
১. ককেশয়েড
ককেশাস পর্বত থেকে এ নামের উৎপত্তি হয়েছে। ধারণা করা হয় এরা প্রথমে ককেশাস পার্বত্য এলাকায় বাস করত। সেখান থেকে তারা মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আমেরিকা, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইরান উত্তর ভারত প্রভৃতি এলাকায় এসে বসবাস করে। ককেশয়েডরা আবার কয়েকটি ভাগে বিভক্ত-
- ক. সোমেটিক জাতি: মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের।
- খ. আর্য বা পেরিয়ান: এই গোষ্ঠী জার্মানি, অস্ট্রিয়া, উত্তর ভারত ও পাকিস্তান এলাকায় বসবাস করে।
- গ. দ্রাবিড়: দক্ষিণ ভারত, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, বঙ্গদেশ প্রভৃতি এলাকায় এদের বসবাস ছিল।
২. মঙ্গোলয়েড
মঙ্গোলীয় পাহাড় বা দেশ থেকে এদের নামকরণ হয়েছে। এরা বাস করে ভারতের থর মরুভূমি এলাকায়। এছাড়া চীন, নেপাল, মঙ্গোলিয়া, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, জাপান, কোরিয়া, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর প্রভৃতি অঞ্চলেও এদের বসবাস রয়েছে।
৩. নিগ্রোয়েড
আফ্রিকা এলাকায় এদের বাসস্থান ছিল। তবে পরে শিল্পবিপ্লবের সময় দাস হিসেবে এদের ইউরোপ ও আমেরিকায় নিয়ে যাওয়া হয়। ফলে আফ্রিকার সমগ্র অঞ্চল এবং ইউরোপের কোনো কোনো দেশে এদের বসবাস রয়েছে।
৪. অস্ট্রোলয়েড
মহাসাগরীয় নিগ্রোদের অস্ট্রোলয়েড বলা হয়। আবার কারো মতে, অস্ট্রেলিয়ার নামানুসারে এদের নাম হয়েছে অস্ট্রোলয়েড। অস্ট্রেলিয়ায় এদের বলা হয় এবোরজিন। অস্ট্রোলয়েডদের একটি অংশ আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে ভারত শাসিত স্থানে বাস করে। তারা বাংলাদেশের রাজশাহী, রংপুর, বগুড়া, প্রভৃতি জেলায় বাস করে।
বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর নৃতাত্ত্বিক পরিচয়
জাতিতাত্ত্বিক নৃবিজ্ঞানীদের মতে, পৃথিবীর চারটি প্রধান নরগোষ্ঠীর প্রতিটির কোনো না কোনো শাখার আগমন ঘটেছে বাংলায়। মনে করা হয় যে, বাংলার প্রাচীন জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে অস্ট্রিক ভাষীরাই সবচেয়ে বেশি। প্রায় ৬ হাজার বছর পূর্বে অস্ট্রেলিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার অঞ্চল থেকে 'অস্ট্রিক' নরগোষ্ঠীর আগমন ঘটে। এদেশের সাঁওতাল, বাঁশফোড়, রাজবংশী প্রভৃতি আদি অস্ট্রেলিয়দের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
এরও প্রায় ২ হাজার বছর পর ইন্দোচীন ও তিব্বত অঞ্চল থেকে 'মঙ্গোলীয়' নর গোষ্ঠীর আগমন ঘটে। প্রায় ১ হাজার বছরের রূপান্তরের মধ্য দিয়ে অস্ট্রিক ও মঙ্গোলীয় নরগোষ্ঠীর সংমিশ্রণে 'বাঙ' নরগোষ্ঠীর উদ্ভব।
এভাবে বিভিন্ন নরগোষ্ঠীয় আগমনের ফলে সংকর নরগোষ্ঠী হিসেবে বাঙালির উদ্ভব হয়েছে। এই আদি জনগোষ্ঠীগুলো দ্বারা নির্মিত সমাজ ও সামাজিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটে আর্যদের আগমনের পর। বাংলাদেশের জনপ্রবাহে মঙ্গোলীয় রক্তেরও পরিচয় পাওয়া যায়। বাঙালির রক্তে নতুন করে মিশ্রণ ঘটল পারস্য-তুর্কিস্তানের শক জাতির আগমনের ফলে।
বাঙালি রক্তে বিদেশি মিশ্রণ প্রক্রিয়া ঐতিহাসিককালেও সুস্পষ্ট। ঐতিহাসিকযুগে আমরা দেখি ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এবং ভারতের বাহির থেকে আসা বিভিন্ন অভিযাত্রী নরগোষ্ঠী বাঙালি জাতি নির্মাণে অবদান রাখতে। গুপ্ত, সেন, বর্মণ, কম্বেজাখ্য, খড়গ, তুর্কি, আফগান, মুগল, পর্তুগিজ, ইংরেজ, আর্মেনীয় প্রভৃতি বহিরাগত জাতি শাসন করেছে বঙ্গ অঞ্চল এবং রেখে গেছে তাদের রক্তের ধারা। এমনকি পাকিস্তান যুগেও আমরা দেখি রক্ত মিশ্রণে চলমান প্রক্রিয়া। বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে এ সংকরত্ব আরও বেগবান হচ্ছে। তাই এক কথায় বলা যায় বাঙালি একটি সংকর জাতি।
জনসংখ্যার ধারণা ও পরিসংখ্যান
খ্রিষ্টীয় সালের প্রারম্ভ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর পৃথিবীর জনসংখ্যা খুব ধীরে এবং পরবর্তীতে তুলনামূলকভাবে দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৬৫০ সালে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৫০০ মিলিয়ন, ১৮৫০ সালে বৃদ্ধি পেয়ে হয় ১.২ বিলিয়ন। ১৮৫০ সালের পর কৃষি ও শিল্প ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক উন্নয়ন সাধিত হয়, এর ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির গতি আরও দ্রুত হয়।
মাত্র ১০০ বছরের মধ্যেই পৃথিবীর মোট জনসংখ্যা আবারও দ্বিগুণ হয়। ১৯৫০ সালে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যা ছিল প্রায় ২.৫৩ বিলিয়ন, যা ২০২০ সালে ৭.৮০ বিলিয়নে এসে দাঁড়িয়েছে। যদি এই হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে, তাহলে ২০৩০ সালে অনুমিত জনসংখ্যা দাঁড়াবে ৮ বিলিয়নের উপরে এবং ২০৫০ সালে অনুমিত জনসংখ্যা দাঁড়াবে ৯.৯০ বিলিয়নের উপরে। গবেষকরা হিসাব করে জানিয়েছেন, বিশ্বের জনসংখ্যা বাড়তে বাড়তে ২০৬৪ সালে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাবে।
| সাল | জনসংখ্যা (বিলিয়ন) |
|---|---|
| ১৯৫০ | ২.৫৩ |
| ১৯৬০ | ৩.০৩ |
| ১৯৭০ | ৩.৬৯ |
| ১৯৮০ | ৪.৪৫ |
| ১৯৯০ | ৫.৩২ |
| ২০০০ | ৬.১৩ |
| ২০১০ | ৬.৯২ |
| ২০১৫ | ৭.৩৫ |
| ২০২০ | ৭.৮০ |
| উৎস: UN, Dept. of Economic and Social Affairs, Population Division, 2020 | |
জনমিতিক পরিমাপ ও ধারণা
জন্মহার: কোনো নির্দিষ্ট এক বছরের প্রতি হাজার নারীর সন্তান জন্মদানের মোট সংখ্যাকে সাধারণ জন্মহার বলে। সাধারণত ১৫-৪৫ অথবা ১৫-৪৯ বছর বয়স পর্যন্ত নারীদের প্রজনন ক্ষমতা (Fertility) থাকে।
- সাধারণ জন্মহার: (নির্দিষ্ট বছরে জন্মিত সন্তান ÷ নির্দিষ্ট বছরের প্রজননক্ষম নারীর সংখ্যা) × ১০০০
- স্থূল জন্মহার: (কোনো বছরের জন্মিত সন্তানের মোট সংখ্যা ÷ বছরের মধ্যকালীন মোট জনসংখ্যা) × ১০০০
মৃত্যুহার: মানুষ মরণশীল। মরণশীলতা জনসংখ্যা বৃদ্ধি প্রক্রিয়াকেই শুধু প্রভাবিত করে না, সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রক্রিয়াকেও প্রভাবিত করে থাকে।
- স্থূল মৃত্যুহার: (কোনো বছরে মৃত্যুবরণকারী মোট সংখ্যা ÷ বছরের মধ্যকালীন মোট জনসংখ্যা) × ১০০০
অন্যান্য ধারণা:
- জনসংখ্যা ঘনত্ব: মোট জনসংখ্যা ÷ মোট ভূমির আয়তন।
- মানুষ-ভূমি অনুপাত: মোট জনসংখ্যা ÷ মোট কার্যকর ভূমির আয়তন (যে সকল ভূমি মানুষের কাজে লাগে এবং সম্পদ সৃষ্টি করতে পারে)।
- কাম্য জনসংখ্যা: কোনো দেশের মোট জনসংখ্যা ও কার্যকর ভূমির অনুপাতে ভারসাম্য থাকলেই তাকে কাম্য জনসংখ্যা বলে।
অভিবাসন (Migration)
জীবন ধারণের মৌলিক ও নানা প্রয়োজনে বহুলোক বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করে। প্রকৃতি অনুযায়ী অভিবাসনকে দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়। যথা-
- অবাধ অভিবাসন (Voluntary migration): নিজের ইচ্ছায় বাসস্থান ত্যাগ করে আপন পছন্দমতো স্থানে বসবাস করাকে অবাধ অভিবাসন বলে।
- বলপূর্বক অভিবাসন (Forced migration): প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক চাপের মুখে কিংবা পরোক্ষভাবে অর্থনৈতিক ও সামাজিক চাপ সৃষ্টির ফলে মানুষ বাধ্য হয়ে যে অভিগমন করে তাকে বলপূর্বক অভিবাসন বলে।
- উদ্বাস্তু (Refugee): বলপূর্বক অভিবাসনের ফলে যে সমস্ত ব্যক্তি কোনো স্থানে আগমন করে ও স্থায়ীভাবে আবাস স্থাপন করে।
- শরণার্থী (Emigre): যারা সাময়িকভাবে আশ্রয় গ্রহণ করে এবং সুযোগমতো স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায় থাকে।
স্থানভেদে অভিগমনকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়: ১. রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ (Internal) ২. আন্তর্জাতিক (International)। যেসব কারণ মানুষকে নতুন স্থানে বসতি স্থাপনে উৎসাহিত করে তাকে আকর্ষণমূলক কারণ (Pull factors) এবং যেসব কারণ পুরাতন বাসস্থান ত্যাগে বাধ্য করে তাকে বিকর্ষণমূলক কারণ (Push factors) বলে।
বাংলাদেশের জনসংখ্যা পরিস্থিতি
বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। জনসংখ্যায় বাংলাদেশ বিশ্বে অষ্টম এবং এশিয়ায় সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে অবস্থান তৃতীয়। এশিয়া মহাদেশে অবস্থান পঞ্চম।
বাংলাদেশের এক নম্বর জাতীয় সামাজিক সমস্যা জনসংখ্যা। বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় জনসংখ্যা নীতি প্রণীত হয় ১৯৭৬ সালে। দ্বিতীয় ও সর্বশেষ জাতীয় জনসংখ্যা নীতি প্রণীত হয় ২০১২ সালে।
- জাতীয় জন্মনিবন্ধন দিবস পালিত হয় ৩ জুলাই (২০০৭ সালে প্রথমবারের মতো পালিত হয়)।
- ম্যালথাসের মতে, জনসংখ্যা বাড়ে জ্যামিতিক হারে (১, ২, ৪, ৮, ১৬, ৩২, ৬৪)।
- ম্যালথাসের মতে, খাদ্যের উৎপাদন বাড়ে গাণিতিক হারে (১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬)।
- বাংলাদেশে প্রথম হিমায়িত ভ্রূণ শিশু (অপ্সরা) জন্মগ্রহণ করে ১৯ সেপ্টেম্বর ২০০৮।
- বাংলাদেশের জাতীয় শিশুনীতি অনুযায়ী শিশুর বয়স (০ থেকে ১৮) বছর।
- বাংলাদেশে কিশোর অপরাধের বয়সসীমা (৭ থেকে ১৬) বছর।
বাংলাদেশের জনসংখ্যার বৈশিষ্ট্য
- জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পেলেও বৃদ্ধির হার হ্রাস পাচ্ছে।
- আয়তন ও সম্পদের তুলনায় জনসংখ্যা বেশি।
- নারী-পুরুষের সংখ্যা প্রায় সমান।
- দেশের অর্ধেক লোক পরনির্ভরশীল।
- জন্মহার মৃত্যুহার অপেক্ষা কম হ্রাস পেয়েছে।
- অধিকাংশ লোক গ্রামে বাস করে।
- উন্নত দেশগুলোর তুলনায় গড় আয়ুষ্কাল অনেক কম।
গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা
- NIPORT: পূর্ণ রূপ National Institute of Population Research & Training. জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ইনস্টিটিউট। অবস্থিত আজিমপুর, ঢাকা। প্রতিষ্ঠা ১৯৭৭। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে জাতীয় স্লোগান 'দুটি সন্তানের বেশি নয়, একটি সন্তান হলে ভালো হয়।'
- HNPSP: পূর্ণ রূপ Health, Nutrition and Population Section Programme. (স্বাস্থ্য, পুষ্টি এবং জনসংখ্যা খাত কর্মসূচি)।
- BNNC: পূর্ণ রূপ Bangladesh National Nutrition Council. গঠিত হয় ২৩ এপ্রিল ১৯৭৫। অবস্থান মোহাম্মদপুর, ঢাকা। সভাপতি প্রধানমন্ত্রী।
- NPC: পূর্ণ রূপ National Population Council. এর প্রধান প্রধানমন্ত্রী।
- জনসংখ্যা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সেল: একটি প্রকল্প যা দেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করে। ১৫ নভেম্বর ১৯৭৫ এর যাত্রা শুরু হয়।
If you believe any content on our website infringes your rights, please contact us. We will review and take action promptly.