টেকসই উন্নয়নের ধারণা ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

আধুনিক বিশ্ব অর্থনীতিতে টেকসই উন্নয়নের ধারণাটি বর্তমানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মূলত, এই ধারণাটি সর্বপ্রথম পাওয়া যায় 'ক্লাব অব রোম' নামক একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিবেদন থেকে। উল্লেখ্য যে, ১৯৬৫ সালে ইতালীয় শিল্পপতি আরেলিয়া পিচ্চাই এবং স্কটিশ বিজ্ঞানী আলেকজান্ডার কিং এই সংস্থাটি গড়ে তোলেন। সে সময় তৎকালীন কয়েকজন রাষ্ট্রপ্রধান, জাতিসংঘের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা, উচ্চপদস্থ রাজনীতিক, সরকারি কর্মকর্তা এবং অর্থনীতিবিদদের সমন্বয়ে এটি গঠিত হয়।
লিমিস টু গ্রোথ প্রতিবেদনের প্রভাব
পরবর্তীতে ১৯৭২ সালে সংস্থাটি বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি এবং এর প্রভাব সম্পর্কে একটি আলোড়ন সৃষ্টিকারী প্রতিবেদন প্রকাশ করে। মূলত এটি গ্রন্থাকারে 'দ্য লিমিট টু গ্রোথ' (১৯৭২) নামে বের হয়। এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের সংগৃহীত তথ্য-উপাত্ত এমআইটির কম্পিউটার সিমুলেশনের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করে এই প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়।
বিশেষ করে প্রতিবেদনে টেকসই উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির সীমা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা হয়। এতে স্পষ্ট করে বলা হয়, উন্নয়নের একটি নির্দিষ্ট সীমারেখা টানতে হবে। অন্যথায়, যেভাবে চলছে তা অব্যাহত থাকলে পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদ আস্তে আস্তে ধ্বংস হয়ে যাবে। বস্তুত, প্রতিবেদনটি বৈশ্বিক চিন্তাবিদদের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব ফেলে এবং এ নিয়ে চারদিকে নানা কথাবার্তা চলতে থাকে।
ব্রান্টল্যান্ড রিপোর্ট ও টেকসই উন্নয়নের সংজ্ঞা
এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৭ সালে জাতিসংঘের 'ওয়ার্ল্ড কমিশন অন এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট' একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এটি 'আওয়ার কমন ফিউচার' বা ব্রান্টল্যান্ড রিপোর্ট নামে পরিচিত। মূলত এই প্রতিবেদনে টেকসই উন্নয়নের ধারণাকে সুস্পষ্ট করা হয়।
তবে এই সংজ্ঞায় 'অভিন্ন ক্ষেত্র' বোঝাতে তারা টেকসই উন্নয়নের বৃহত্তর সংজ্ঞায় ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদের সুরক্ষাকে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। পাশাপাশি, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমতাকেও অপরিহার্য শর্ত হিসেবে ধরা হয়েছে। অর্থাৎ, টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করে যেন প্রাকৃতিক ভারসাম্য (ইকোলজিক্যাল ব্যালান্স) এবং মানুষের আর্থসামাজিক সাম্য বজায় থাকে।
এমডিজি থেকে এসডিজি: উন্নয়নের ধারাবাহিকতা
টেকসই উন্নয়নের এই ধারণা বিশ্ববিবেককে তাড়িত করে। ফলে বিশ্বসমাজ জাতিসংঘের মাধ্যমে একত্র হয়। উদাহরণস্বরূপ, ২০০০ সালে বিশ্ব সংস্থাটি 'সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা' বা এমডিজি (MDG) প্রণয়ন করে। সে সময় এমডিজিতে টেকসই উন্নয়নের দিকেই বেশি নজর দেওয়া হয়, যাতে পরিবেশ বিশেষ গুরুত্ব পায়।
অন্যদিকে, এমডিজিতে সদস্য দেশগুলোর জন্য আটটি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল, যা ২০১৫ সালের মধ্যে পূরণ করতে বলা হয়। এর মধ্য দিয়ে বিশ্বজুড়ে স্থায়ী বা টেকসই উন্নয়ন তৎপরতায় একটা গতি আসে। পরবর্তীতে সেই গতি ধরে রাখতেই ২০১৫ সালের শেষদিকে জাতিসংঘ ১৫ বছরের জন্য আরো একগুচ্ছ লক্ষ্য নির্ধারণ করে। এর নাম দেওয়া হয় 'টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা' বা এসডিজি (SDG)। এতে ১৭টি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়, যা ২০৩০ সালের মধ্যে পূরণ করতে বলা হয়।
এসডিজির ১৭টি লক্ষ্যমাত্রা
টেকসই উন্নয়নের জন্য জাতিসংঘ ঘোষিত ১৭টি লক্ষ্যমাত্রা নিচে আলোচনা করা হলো:
- দারিদ্র্য বিমোচন [No Poverty]: সর্বত্র এবং সব ধরনের দরিদ্রতা দূর করা।
- ক্ষুধামুক্তি [Zero Hunger]: ক্ষুধা দূর করা, খাদ্য নিরাপত্তা ও উন্নত পুষ্টি অর্জন এবং টেকসই কৃষিব্যবস্থা চালু করা।
- সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ [Good Health & Well being]: স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন নিশ্চিত করা এবং সব বয়সের সকলের জন্য কল্যাণ বৃদ্ধি।
- মানসম্মত শিক্ষা [Quality Education]: অন্তর্ভুক্তিমূলক, সমতাপূর্ণ ও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা এবং সবার জন্য জীবনব্যাপী শিক্ষা সুযোগ সৃষ্টি।
- জেন্ডার সমতা [Gender Equality]: জেন্ডার সমতা অর্জন করা এবং সব নারী ও তরুণীর ক্ষমতায়ন।
- বিশুদ্ধ পানি ও পয়োনিষ্কাশন [Clean Water & Sanitation]: সবার জন্য পানি ও পয়োনিষ্কাশনের সুযোগ এবং এর টেকসই ব্যবস্থাপনা।
- ব্যয়সাধ্য ও টেকসই জ্বালানি [Affordable & Sustainable Energy]: সবার জন্য ব্যয়সাধ্য, নির্ভরযোগ্য, টেকসই এবং আধুনিক জ্বালানির সুযোগ নিশ্চিতকরণ।
- সবার জন্য ভালো কাজ এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি [Decent Work & Economic Growth]: সবার জন্য টেকসই, অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, পূর্ণকালীন ও উৎপাদনশীল কর্মসংস্থান এবং ভালো কাজ নিশ্চিতকরণ।
- শিল্প, উদ্ভাবন ও উন্নত অবকাঠামো [Industry, Innovation & Infrastructure]: দীর্ঘস্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণ করা, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং টেকসই শিল্পায়ন এবং উদ্ভাবনকে প্রেরণা দেওয়া।
- বৈষম্য হ্রাসকরণ [Reduced Inequalities]: দেশের ভেতরে এবং বিভিন্ন দেশের মধ্যকার বৈষম্য দূর করা।
- টেকসই শহর ও সম্প্রদায় [Sustainable Cities and Communities]: শহর এবং মানুষের বাসস্থানকে অন্তর্ভুক্তিমূলক, নিরাপদ, দীর্ঘস্থায়ী এবং টেকসই করে তোলা।
- দায়িত্বশীল ব্যবহার [Responsible Consumption & Production]: টেকসই ভোগ ও উৎপাদন রীতি নিশ্চিত করা।
- জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধ [Climate Action]: জলবায়ুর পরিবর্তন ও প্রভাব মোকাবিলায় জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ।
- সমুদ্রের সুরক্ষা [Life below Water]: টেকসই উন্নয়নের জন্য মহাসাগর, সাগর এবং সামুদ্রিক সম্পদের সংরক্ষণ ও টেকসই ব্যবহার।
- ভূমির সুরক্ষা [Life on Land]: ভূমির উপরিস্থ পরিবেশ-ব্যবস্থার সুরক্ষা, পুনঃস্থাপন এবং টেকসই ব্যবহার; টেকসই বন ব্যবস্থাপনা; মরুকরণ রোধ ও বন্ধ করা; ভূমিক্ষয় রোধ করা এবং জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি বন্ধ করা।
- শান্তি ও ন্যায়বিচার [Peace, Justice & Strong Institutions]: টেকসই উন্নয়নের জন্য শান্তিপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ প্রতিষ্ঠা; সকলের জন্য ন্যায়বিচারের সুযোগ সৃষ্টি এবং সর্বস্তরে কার্যকর, জবাবদিহি এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা।
- লক্ষ্য অর্জনের জন্য অংশীদারত্ব [Partnerships for the Goals]: বাস্তবায়নের উপায়গুলো শক্তিশালী করা এবং টেকসই উন্নয়নের জন্য বৈশ্বিক অংশীদারত্ব পুনর্জীবিত করা।
বাংলাদেশের অবস্থান ও বর্তমান প্রেক্ষাপট
এসডিজি সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতি
এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে কার্যক্রম শুরু করেছে। উল্লেখ্য যে, ২০২১ সালের এসডিজি সূচকে বিশ্বের ১৬৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৯তম। তবে, ৪ বছর আগে ২০১৭ সালের সূচকে ১৫৭টি দেশের মধ্যে ১২০তম অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও বাস্তবতা
পাশাপাশি এমডিজির লক্ষ্যসমূহের মধ্যে অভ্যন্তরীণ উন্নয়ন যেমন আছে, তেমনি বৈশ্বিক অংশীদারত্বের স্থিতিশীলতা আনার কর্মসূচিও আছে। পরিবর্তনশীল বিশ্বের সমতা ও বৈষম্যহীন উন্নয়ন নিশ্চিত করতে ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি অর্জন করতে হবে। পৃথিবীর সব দেশ এ লক্ষ্য অর্জনে অঙ্গীকারবদ্ধ। কিন্তু বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে এসডিজির লক্ষ্যসমূহ অর্জনে অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে।
এসডিজি অর্জনে প্রধান চ্যালেঞ্জসমূহ
১. সম্পদের অসম বণ্টন ও বৈষম্য
বাস্তবে, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো সম্পদের অসম বণ্টন, বৈষম্য ও দারিদ্র্য। কারণ, আমরা একদিকে যখন দারিদ্র্য বিমোচনের কথা বলছি, অন্যদিকে বিশ্বে তখন সম্পদের বৈষম্য বেড়েই চলছে। ফলস্বরূপ, ধনী-গরিবের ক্রমবর্ধমান ব্যবধান দারিদ্র্যকে আরো প্রকট করে তুলেছে।
সুতরাং বিশ্বে সম্পদের বৈষম্য যত বাড়বে, ধনী ও গরিবের বিভক্তি তত প্রকট হবে। আর বিভক্তি যত বাড়বে, বিদ্বেষ-বিভেদও তত বাড়তে থাকবে। মূলত বর্তমান পৃথিবীব্যাপী যে উন্নয়ন ঘটছে তা ভারসাম্যহীন। এই উন্নয়ন হচ্ছে দেশে দেশে এবং মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টিকারী ও বিভেদ বর্ধনকারী। এই প্রকট এবং ক্রমবর্ধমান বৈষম্য ও বিভক্তি টেকসই উন্নয়নের পথে বাংলাদেশের একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
যদিও বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে দারিদ্র্য উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। তবে লক্ষণীয় দিক হলো আয় ও ভোগ বৈষম্য। গত কয়েক বছরে এই বৈষম্য কিছুটা কমেছে, তথাপি বিদ্যমান বৈষম্য প্রকট। আমাদের সম্পদের বৈষম্য ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। সমাজে এক শ্রেণির মানুষ ভূমি দখল, নদী দখল, বন দখল এমনকি অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান কুক্ষিগত করে অপরিমিত সম্পদের মালিক হচ্ছে। এর ফলে ভারসাম্যহীন সমাজ গড়ে উঠছে এবং ধনী-গরিবের ব্যবধান বাড়ছে।
২. পরিবেশ দূষণ ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়
অন্যদিকে, টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অন্যতম চ্যালেঞ্জ হলো পরিবেশ দূষণ, জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়। যেমন, এক শ্রেণির মানুষ অবৈধভাবে নদী দখলের ফলে জলজ জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ছে। এতে নদীপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাছাড়া, অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও নগরায়ণের ফলে সৃষ্ট পরিবেশ দূষণ নাগরিক জীবনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
অধিকন্তু, অনিয়ন্ত্রিত জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের ফলে জলবায়ু পরিবর্তনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যাচ্ছে। প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার অভাব উন্নয়নের গতিকে বাধাগ্রস্ত করছে।
৩. প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয়হীনতা
একইভাবে পাবলিক ও প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়হীনতা টেকসই উন্নয়নকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করছে। মূলত জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার অভাব সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ব্যক্তি পর্যায় থেকে সামষ্টিক পর্যায়—সবক্ষেত্রে বৈষম্য, সমন্বয়হীনতা এবং অবকাঠামোগত দুর্বলতাই টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশের বড় চ্যালেঞ্জ।
এসডিজি বাস্তবায়নে করণীয় পদক্ষেপ
প্রাতিষ্ঠানিক ও নীতিগত কৌশল
প্রথমত, সবক্ষেত্রে বৈষম্য সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে আয়, ভোগ, জেন্ডার, অঞ্চল ও সম্পদ বৈষম্য যথাসম্ভব কমিয়ে আনতে হবে। এ লক্ষ্যে যথাযথ কৌশল ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। সরকার ও অন্যান্য পর্যায়ে অংশীজনকে সাথে নিয়ে সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। এসডিজি বাস্তবায়নে বিস্তারিত করণীয়গুলো নিচে আলোচনা করা হলো:
সুনির্দিষ্ট কিছু পদক্ষেপ
- সম্পদ আহরণ ও তথ্যভান্ডার: অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল থেকে সম্পদ আহরণে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। অবাধ তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত করে বিশ্লেষণপূর্বক টেকসই উন্নয়ন কর্মসূচিতে দ্রুত তথ্যভান্ডার গড়ে তোলা ও তার ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
- পরিবেশ সংরক্ষণ: জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা, পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়নে প্রয়োজনানুসারে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
- কর্মসংস্থান ও দক্ষতা বৃদ্ধি: সাধারণ মানুষের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা ও সম্পদের ন্যায্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, প্রশিক্ষণ এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। এতে তারা নিজেদের দক্ষতা কাজে লাগিয়ে সম্পদ সংগ্রহের পাশাপাশি সমাজ এবং দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারবে।
- নীতিমালা ও মনিটরিং: নীতি-কাঠামোগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পরিকল্পনা প্রণয়ন, প্রাতিষ্ঠানিক ও আর্থসামাজিক পরিবেশ সমৃদ্ধ করতে হবে। একই সাথে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রতিটি পর্যায়ে মনিটরিং ও মেনটরিংয়ের ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে।
- রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও পাচার রোধ: সব মহলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করে টেকসই উন্নয়ন কর্মসূচি কার্যকরভাবে বাস্তবায়নে রাজনৈতিক অঙ্গীকার জরুরি। পাশাপাশি বিদেশে সম্পদ পাচার বন্ধে আরো কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
- গ্রামীণ অর্থনীতি ও বাজেট বরাদ্দ: গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশে গ্রামীণ অ-কৃষি খাতকে যথেষ্ট প্রাধান্য দিতে হবে। শিক্ষা, সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য, পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়নে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এসব খাতে বাজেট বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি ব্যবস্থাপনা ও তদারকি বাড়াতে হবে।
- পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী: সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া বিভিন্ন জনগোষ্ঠী এবং ভৌগোলিকভাবে পিছিয়ে পড়া দুর্গম অঞ্চল বিশেষ বিবেচনায় রেখে উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ জরুরি। অতিদারিদ্র্য ও দারিদ্র্যের হার কমাতে প্রয়োজনে বিশেষ বিশেষ কর্মসূচি হাতে নিতে হবে।
- জ্বালানি খাত: জ্বালানি খাতকে বর্তমান বাজেটে অগ্রাধিকার দিলেও তা বাস্তবায়নে কঠোর তদারকি প্রয়োজন। গ্যাসের ক্ষেত্রে প্রাপ্যতা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে স্থলভাগ ও সমুদ্র অনুসন্ধান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় জোরদার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
- সমন্বিত প্রচেষ্টা: তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ ব্যবহার (অপব্যবহার) রোধ করতে হবে। তবে টেকসই উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে স্ব স্ব অবস্থানে থেকে প্রত্যেককেই এগিয়ে আসতে হবে। সকলের সচেতনতা রাষ্ট্রকে উন্নয়নের আরও এক ধাপ সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
সচরাচর জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQ)
টেকসই উন্নয়নের ধারণা ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট | Sustainable Development Goals
আধুনিক বিশ্ব অর্থনীতিতে টেকসই উন্নয়নের ধারণাটি বর্তমানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মূলত, এই ধারণাটি সর্বপ্রথম পাওয়া যায় 'ক্লাব অব রোম' নামক একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিবেদন থেকে। উল্লেখ্য যে, ১৯৬৫ সালে ইতালীয় শিল্পপতি আরেলিয়া পিচ্চাই এবং স্কটিশ বিজ্ঞানী আলেকজান্ডার কিং এই সংস্থাটি গড়ে তোলেন। সে সময় তৎকালীন কয়েকজন রাষ্ট্রপ্রধান, জাতিসংঘের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা, উচ্চপদস্থ রাজনীতিক, সরকারি কর্মকর্তা এবং অর্থনীতিবিদদের সমন্বয়ে এটি গঠিত হয়।
লিমিস টু গ্রোথ প্রতিবেদনের প্রভাব
পরবর্তীতে ১৯৭২ সালে সংস্থাটি বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি এবং এর প্রভাব সম্পর্কে একটি আলোড়ন সৃষ্টিকারী প্রতিবেদন প্রকাশ করে। মূলত এটি গ্রন্থাকারে 'দ্য লিমিট টু গ্রোথ' (১৯৭২) নামে বের হয়। এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের সংগৃহীত তথ্য-উপাত্ত এমআইটির কম্পিউটার সিমুলেশনের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করে এই প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়।
বিশেষ করে প্রতিবেদনে টেকসই উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির সীমা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা হয়। এতে স্পষ্ট করে বলা হয়, উন্নয়নের একটি নির্দিষ্ট সীমারেখা টানতে হবে। অন্যথায়, যেভাবে চলছে তা অব্যাহত থাকলে পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদ আস্তে আস্তে ধ্বংস হয়ে যাবে। বস্তুত, প্রতিবেদনটি বৈশ্বিক চিন্তাবিদদের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব ফেলে এবং এ নিয়ে চারদিকে নানা কথাবার্তা চলতে থাকে।
ব্রান্টল্যান্ড রিপোর্ট ও টেকসই উন্নয়নের সংজ্ঞা
এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৭ সালে জাতিসংঘের 'ওয়ার্ল্ড কমিশন অন এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট' একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এটি 'আওয়ার কমন ফিউচার' বা ব্রান্টল্যান্ড রিপোর্ট নামে পরিচিত। মূলত এই প্রতিবেদনে টেকসই উন্নয়নের ধারণাকে সুস্পষ্ট করা হয়।
তবে এই সংজ্ঞায় 'অভিন্ন ক্ষেত্র' বোঝাতে তারা টেকসই উন্নয়নের বৃহত্তর সংজ্ঞায় ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদের সুরক্ষাকে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। পাশাপাশি, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমতাকেও অপরিহার্য শর্ত হিসেবে ধরা হয়েছে। অর্থাৎ, টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করে যেন প্রাকৃতিক ভারসাম্য (ইকোলজিক্যাল ব্যালান্স) এবং মানুষের আর্থসামাজিক সাম্য বজায় থাকে।
এমডিজি থেকে এসডিজি: উন্নয়নের ধারাবাহিকতা
টেকসই উন্নয়নের এই ধারণা বিশ্ববিবেককে তাড়িত করে। ফলে বিশ্বসমাজ জাতিসংঘের মাধ্যমে একত্র হয়। উদাহরণস্বরূপ, ২০০০ সালে বিশ্ব সংস্থাটি 'সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা' বা এমডিজি (MDG) প্রণয়ন করে। সে সময় এমডিজিতে টেকসই উন্নয়নের দিকেই বেশি নজর দেওয়া হয়, যাতে পরিবেশ বিশেষ গুরুত্ব পায়।
অন্যদিকে, এমডিজিতে সদস্য দেশগুলোর জন্য আটটি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল, যা ২০১৫ সালের মধ্যে পূরণ করতে বলা হয়। এর মধ্য দিয়ে বিশ্বজুড়ে স্থায়ী বা টেকসই উন্নয়ন তৎপরতায় একটা গতি আসে। পরবর্তীতে সেই গতি ধরে রাখতেই ২০১৫ সালের শেষদিকে জাতিসংঘ ১৫ বছরের জন্য আরো একগুচ্ছ লক্ষ্য নির্ধারণ করে। এর নাম দেওয়া হয় 'টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা' বা এসডিজি (SDG)। এতে ১৭টি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়, যা ২০৩০ সালের মধ্যে পূরণ করতে বলা হয়।
এসডিজির ১৭টি লক্ষ্যমাত্রা
টেকসই উন্নয়নের জন্য জাতিসংঘ ঘোষিত ১৭টি লক্ষ্যমাত্রা নিচে আলোচনা করা হলো:
- দারিদ্র্য বিমোচন [No Poverty]: সর্বত্র এবং সব ধরনের দরিদ্রতা দূর করা।
- ক্ষুধামুক্তি [Zero Hunger]: ক্ষুধা দূর করা, খাদ্য নিরাপত্তা ও উন্নত পুষ্টি অর্জন এবং টেকসই কৃষিব্যবস্থা চালু করা।
- সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ [Good Health & Well being]: স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন নিশ্চিত করা এবং সব বয়সের সকলের জন্য কল্যাণ বৃদ্ধি।
- মানসম্মত শিক্ষা [Quality Education]: অন্তর্ভুক্তিমূলক, সমতাপূর্ণ ও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা এবং সবার জন্য জীবনব্যাপী শিক্ষা সুযোগ সৃষ্টি।
- জেন্ডার সমতা [Gender Equality]: জেন্ডার সমতা অর্জন করা এবং সব নারী ও তরুণীর ক্ষমতায়ন।
- বিশুদ্ধ পানি ও পয়োনিষ্কাশন [Clean Water & Sanitation]: সবার জন্য পানি ও পয়োনিষ্কাশনের সুযোগ এবং এর টেকসই ব্যবস্থাপনা।
- ব্যয়সাধ্য ও টেকসই জ্বালানি [Affordable & Sustainable Energy]: সবার জন্য ব্যয়সাধ্য, নির্ভরযোগ্য, টেকসই এবং আধুনিক জ্বালানির সুযোগ নিশ্চিতকরণ।
- সবার জন্য ভালো কাজ এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি [Decent Work & Economic Growth]: সবার জন্য টেকসই, অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, পূর্ণকালীন ও উৎপাদনশীল কর্মসংস্থান এবং ভালো কাজ নিশ্চিতকরণ।
- শিল্প, উদ্ভাবন ও উন্নত অবকাঠামো [Industry, Innovation & Infrastructure]: দীর্ঘস্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণ করা, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং টেকসই শিল্পায়ন এবং উদ্ভাবনকে প্রেরণা দেওয়া।
- বৈষম্য হ্রাসকরণ [Reduced Inequalities]: দেশের ভেতরে এবং বিভিন্ন দেশের মধ্যকার বৈষম্য দূর করা।
- টেকসই শহর ও সম্প্রদায় [Sustainable Cities and Communities]: শহর এবং মানুষের বাসস্থানকে অন্তর্ভুক্তিমূলক, নিরাপদ, দীর্ঘস্থায়ী এবং টেকসই করে তোলা।
- দায়িত্বশীল ব্যবহার [Responsible Consumption & Production]: টেকসই ভোগ ও উৎপাদন রীতি নিশ্চিত করা।
- জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধ [Climate Action]: জলবায়ুর পরিবর্তন ও প্রভাব মোকাবিলায় জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ।
- সমুদ্রের সুরক্ষা [Life below Water]: টেকসই উন্নয়নের জন্য মহাসাগর, সাগর এবং সামুদ্রিক সম্পদের সংরক্ষণ ও টেকসই ব্যবহার।
- ভূমির সুরক্ষা [Life on Land]: ভূমির উপরিস্থ পরিবেশ-ব্যবস্থার সুরক্ষা, পুনঃস্থাপন এবং টেকসই ব্যবহার; টেকসই বন ব্যবস্থাপনা; মরুকরণ রোধ ও বন্ধ করা; ভূমিক্ষয় রোধ করা এবং জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি বন্ধ করা।
- শান্তি ও ন্যায়বিচার [Peace, Justice & Strong Institutions]: টেকসই উন্নয়নের জন্য শান্তিপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ প্রতিষ্ঠা; সকলের জন্য ন্যায়বিচারের সুযোগ সৃষ্টি এবং সর্বস্তরে কার্যকর, জবাবদিহি এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা।
- লক্ষ্য অর্জনের জন্য অংশীদারত্ব [Partnerships for the Goals]: বাস্তবায়নের উপায়গুলো শক্তিশালী করা এবং টেকসই উন্নয়নের জন্য বৈশ্বিক অংশীদারত্ব পুনর্জীবিত করা।
বাংলাদেশের অবস্থান ও বর্তমান প্রেক্ষাপট
এসডিজি সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতি
এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে কার্যক্রম শুরু করেছে। উল্লেখ্য যে, ২০২১ সালের এসডিজি সূচকে বিশ্বের ১৬৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৯তম। তবে, ৪ বছর আগে ২০১৭ সালের সূচকে ১৫৭টি দেশের মধ্যে ১২০তম অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও বাস্তবতা
পাশাপাশি এমডিজির লক্ষ্যসমূহের মধ্যে অভ্যন্তরীণ উন্নয়ন যেমন আছে, তেমনি বৈশ্বিক অংশীদারত্বের স্থিতিশীলতা আনার কর্মসূচিও আছে। পরিবর্তনশীল বিশ্বের সমতা ও বৈষম্যহীন উন্নয়ন নিশ্চিত করতে ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি অর্জন করতে হবে। পৃথিবীর সব দেশ এ লক্ষ্য অর্জনে অঙ্গীকারবদ্ধ। কিন্তু বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে এসডিজির লক্ষ্যসমূহ অর্জনে অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে।
এসডিজি অর্জনে প্রধান চ্যালেঞ্জসমূহ
১. সম্পদের অসম বণ্টন ও বৈষম্য
বাস্তবে, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো সম্পদের অসম বণ্টন, বৈষম্য ও দারিদ্র্য। কারণ, আমরা একদিকে যখন দারিদ্র্য বিমোচনের কথা বলছি, অন্যদিকে বিশ্বে তখন সম্পদের বৈষম্য বেড়েই চলছে। ফলস্বরূপ, ধনী-গরিবের ক্রমবর্ধমান ব্যবধান দারিদ্র্যকে আরো প্রকট করে তুলেছে।
সুতরাং বিশ্বে সম্পদের বৈষম্য যত বাড়বে, ধনী ও গরিবের বিভক্তি তত প্রকট হবে। আর বিভক্তি যত বাড়বে, বিদ্বেষ-বিভেদও তত বাড়তে থাকবে। মূলত বর্তমান পৃথিবীব্যাপী যে উন্নয়ন ঘটছে তা ভারসাম্যহীন। এই উন্নয়ন হচ্ছে দেশে দেশে এবং মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টিকারী ও বিভেদ বর্ধনকারী। এই প্রকট এবং ক্রমবর্ধমান বৈষম্য ও বিভক্তি টেকসই উন্নয়নের পথে বাংলাদেশের একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
যদিও বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে দারিদ্র্য উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। তবে লক্ষণীয় দিক হলো আয় ও ভোগ বৈষম্য। গত কয়েক বছরে এই বৈষম্য কিছুটা কমেছে, তথাপি বিদ্যমান বৈষম্য প্রকট। আমাদের সম্পদের বৈষম্য ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। সমাজে এক শ্রেণির মানুষ ভূমি দখল, নদী দখল, বন দখল এমনকি অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান কুক্ষিগত করে অপরিমিত সম্পদের মালিক হচ্ছে। এর ফলে ভারসাম্যহীন সমাজ গড়ে উঠছে এবং ধনী-গরিবের ব্যবধান বাড়ছে।
২. পরিবেশ দূষণ ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়
অন্যদিকে, টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অন্যতম চ্যালেঞ্জ হলো পরিবেশ দূষণ, জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়। যেমন, এক শ্রেণির মানুষ অবৈধভাবে নদী দখলের ফলে জলজ জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ছে। এতে নদীপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাছাড়া, অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও নগরায়ণের ফলে সৃষ্ট পরিবেশ দূষণ নাগরিক জীবনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
অধিকন্তু, অনিয়ন্ত্রিত জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের ফলে জলবায়ু পরিবর্তনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যাচ্ছে। প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার অভাব উন্নয়নের গতিকে বাধাগ্রস্ত করছে।
৩. প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয়হীনতা
একইভাবে পাবলিক ও প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়হীনতা টেকসই উন্নয়নকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করছে। মূলত জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার অভাব সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ব্যক্তি পর্যায় থেকে সামষ্টিক পর্যায়—সবক্ষেত্রে বৈষম্য, সমন্বয়হীনতা এবং অবকাঠামোগত দুর্বলতাই টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশের বড় চ্যালেঞ্জ।
এসডিজি বাস্তবায়নে করণীয় পদক্ষেপ
প্রাতিষ্ঠানিক ও নীতিগত কৌশল
প্রথমত, সবক্ষেত্রে বৈষম্য সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে আয়, ভোগ, জেন্ডার, অঞ্চল ও সম্পদ বৈষম্য যথাসম্ভব কমিয়ে আনতে হবে। এ লক্ষ্যে যথাযথ কৌশল ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। সরকার ও অন্যান্য পর্যায়ে অংশীজনকে সাথে নিয়ে সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। এসডিজি বাস্তবায়নে বিস্তারিত করণীয়গুলো নিচে আলোচনা করা হলো:
সুনির্দিষ্ট কিছু পদক্ষেপ
- সম্পদ আহরণ ও তথ্যভান্ডার: অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল থেকে সম্পদ আহরণে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। অবাধ তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত করে বিশ্লেষণপূর্বক টেকসই উন্নয়ন কর্মসূচিতে দ্রুত তথ্যভান্ডার গড়ে তোলা ও তার ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
- পরিবেশ সংরক্ষণ: জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা, পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়নে প্রয়োজনানুসারে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
- কর্মসংস্থান ও দক্ষতা বৃদ্ধি: সাধারণ মানুষের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা ও সম্পদের ন্যায্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, প্রশিক্ষণ এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। এতে তারা নিজেদের দক্ষতা কাজে লাগিয়ে সম্পদ সংগ্রহের পাশাপাশি সমাজ এবং দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারবে।
- নীতিমালা ও মনিটরিং: নীতি-কাঠামোগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পরিকল্পনা প্রণয়ন, প্রাতিষ্ঠানিক ও আর্থসামাজিক পরিবেশ সমৃদ্ধ করতে হবে। একই সাথে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রতিটি পর্যায়ে মনিটরিং ও মেনটরিংয়ের ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে।
- রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও পাচার রোধ: সব মহলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করে টেকসই উন্নয়ন কর্মসূচি কার্যকরভাবে বাস্তবায়নে রাজনৈতিক অঙ্গীকার জরুরি। পাশাপাশি বিদেশে সম্পদ পাচার বন্ধে আরো কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
- গ্রামীণ অর্থনীতি ও বাজেট বরাদ্দ: গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশে গ্রামীণ অ-কৃষি খাতকে যথেষ্ট প্রাধান্য দিতে হবে। শিক্ষা, সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য, পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়নে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এসব খাতে বাজেট বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি ব্যবস্থাপনা ও তদারকি বাড়াতে হবে।
- পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী: সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া বিভিন্ন জনগোষ্ঠী এবং ভৌগোলিকভাবে পিছিয়ে পড়া দুর্গম অঞ্চল বিশেষ বিবেচনায় রেখে উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ জরুরি। অতিদারিদ্র্য ও দারিদ্র্যের হার কমাতে প্রয়োজনে বিশেষ বিশেষ কর্মসূচি হাতে নিতে হবে।
- জ্বালানি খাত: জ্বালানি খাতকে বর্তমান বাজেটে অগ্রাধিকার দিলেও তা বাস্তবায়নে কঠোর তদারকি প্রয়োজন। গ্যাসের ক্ষেত্রে প্রাপ্যতা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে স্থলভাগ ও সমুদ্র অনুসন্ধান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় জোরদার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
- সমন্বিত প্রচেষ্টা: তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ ব্যবহার (অপব্যবহার) রোধ করতে হবে। তবে টেকসই উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে স্ব স্ব অবস্থানে থেকে প্রত্যেককেই এগিয়ে আসতে হবে। সকলের সচেতনতা রাষ্ট্রকে উন্নয়নের আরও এক ধাপ সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
সচরাচর জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQ)
If you believe any content on our website infringes your rights, please contact us. We will review and take action promptly.