কালামে আ'লা হযরত: ছন্দের শৈল্পিকতায় আকীদা শিক্ষা

কালামে আ'লা হযরত: ছন্দের শৈল্পিকতায় আকীদা শিক্ষা, আ'লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা খান (র.)-এর কালামে ঈমানের রুকন, তাওহিদ, রিসালাত, এবং সাহাবা ও আহলে বাইতের

কালামে আ'লা হযরত: ছন্দের শৈল্পিকতায় আকীদা শিক্ষা

মুহাম্মদ শফিউল বশর নঈমী
প্রভাষক, আল কুরআন অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ
কালামে আ'লা হযরত: ছন্দের শৈল্পিকতায় আকীদা শিক্ষা

ঈমান ও বিশ্বাসের বিশুদ্ধতা ছাড়া কোনো আমলই আল্লাহর দরবারে কবুল হয় না। ইসলামি আকিদা হলো মুমিনের জীবনের মূল ভিত্তি। আ'লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা খান (র.) তাঁর ক্ষুরধার লেখনী ও ছন্দের জাদুতে কঠিন আকিদাগত বিষয়গুলোকে অত্যন্ত সহজ ও প্রাঞ্জলভাবে তুলে ধরেছেন। তাঁর কালাম বা কবিতাগুলো শুধু সাহিত্য নয়, বরং ঈমানের এক জীবন্ত পাঠশালা। এই প্রবন্ধে আমরা দেখব কীভাবে তিনি ছন্দের শৈল্পিকতায় তাওহিদ, রিসালাত, সাহাবায়ে কেরাম এবং আখেরাতের প্রতি বিশ্বাসকে অন্তরে গেঁথে দিয়েছেন।

ঈমান কী এবং ঠিক কী কী বিশ্বাস রাখলে একজন মানুষ মুমিন হয়ে ওঠে, সে ব্যাপারে ইমাম আ'যম আবু হানিফা নু'মান ইবনু সাবিত রহ. 'আল-ফিকহুল আকবার' গ্রন্থে আরকানুল ঈমান বর্ণনায় বলেন:

أصْلُ التَّوْحِيدِ وَمَا يَصِحُ الاعْتِقَادُ عَلَيْهِ يَجِبُ أَنْ يَقُولُ آمَنْتُ بِاللهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ وَالْبَعْثَ بَعْدَ المَوْت والقدر خَيْرِهِ وَشَرِّهِ مِنَ الله تَعَالَي وَالْحِسَابُ وَالْمِيزَانُ وَالْجَنَّةَ وَالنَّارُ حَقٌّ كُلَّهُ

অনুবাদ: "তাওহিদের ভিত্তি, যার উপরই আকীদার শুদ্ধতা নির্ভর করে তা হলো- অবশ্যই বলতে হবে: আমি ঈমান এনেছি- ১. আল্লাহ-তে ২. তাঁর ফিরিশতাগণে ৩. আল্লাহর কিতাবসমূহে, ৪. তাঁর রাসূলগণে, ৫. (আখিরাতে) মৃত্যুর পরে পুনরুত্থানে ৬. তাকদিরের ভালো এবং মন্দ মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে। আর হিসাব, মীযান, জান্নাত, জাহান্নাম, এ সবই সত্য; এগুলো আখিরাতের ঈমানে অন্তর্ভুক্ত। সমস্ত আকীদাগত বিষয়াদি এই ছয়টি আরকানের অন্তর্ভুক্ত।"

ইসলামে আকীদা-বিশ্বাসের গুরুত্ব অপরিসীম। মুজাদ্দিদে দ্বীন ও মিল্লাত, ইমামে ইশ্ক ও মহব্বত, আ'লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা খান বেরলভী রহ. তাঁর ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে ইসলামি আকীদার এই মৌলিক ও কঠিন বিষয়গুলো মুসলিম মানসপটে গেঁথে দিতে চেয়েছিলেন। তিনি তাঁর লেখনী ও কবিতার মাধ্যমে তা অত্যন্ত সফলভাবে আঞ্জাম দিয়েছেন। তিনি তাঁর অমর কাব্যগ্রন্থ "হাদায়েকে বখশিশ"-এ ইসলামি আকীদার প্রতিটি দিক অত্যন্ত চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন, যা একদিকে যেমন হৃদয়গ্রাহী, অন্যদিকে বুদ্ধিবৃত্তিক ও দলীলভিত্তিক।

প্রথম রুকন: আল্লাহর প্রতি আকীদা

সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ তা'আলা এক ও অদ্বিতীয়। তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন। সমস্ত মাখলুক তাঁরই সৃষ্টি এবং তাঁরই মুখাপেক্ষী। আ'লা হযরত আল্লাহর বড়ত্ব ও একত্ববাদের বর্ণনা দিয়ে বলেন:

وهى وحدہ لا شریک لہ وہ نہ وحدت عددی و لا ضدی
"তিনি এক, তাঁর কোনো শরীক নেই। তাঁর একত্ব সংখ্যাবাচক এক নয় এবং তাঁর বিপরীতেও কেউ নেই।"

অর্থাৎ, আল্লাহর একত্ববাদ কোনো গণনার বিষয় নয়, বরং তিনি সত্তাগতভাবেই এক ও একক।

দ্বিতীয় রুকন: ফিরিশতাদের প্রতি আকীদা

নূরের তৈরি এই মাখলুকাত মহান আল্লাহর নির্দেশে বিভিন্ন দায়িত্বে নিয়োজিত। তারা নিষ্পাপ এবং সর্বদা আল্লাহর জিকিরে মগ্ন। আ'লা হযরত বলেন:

نوری بشر و حور و ملائک میں ہے ہر سو * چرچا تیرا کس منہ سے ہو ایفا تیرا
"নূরি বশর, হুর ও ফেরেশতা সবখানেই তোর চর্চা, কোন মুখে হবে তোর প্রশংসা।"

তৃতীয় রুকন: কিতাবসমূহের প্রতি আকীদা

আসমানি কিতাবসমূহের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা ঈমানের অপরিহার্য অংশ। আ'লা হযরত আল-কুরআনকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দিয়ে বলেন:

قرآن میں ہو غوطہ زن اے مرد مسلماں * الله کرے تجھ کو عطا جدت کردار
"হে মুসলিম! কুরআনের সাগরে ডুব দাও, আল্লাহ তোমাকে চরিত্রের নতুনত্ব দান করবেন।"

চতুর্থ রুকন: রাসূলগণের প্রতি আকীদা

নবী-রাসূলগণ মহান আল্লাহর প্রেরিত দূত। তাঁদের প্রতি বিশ্বাস ও ভালোবাসা ছাড়া ঈমান পূর্ণ হয় না। বিশেষ করে সাইয়্যেদুল মুরসালিন হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ভালোবাসা ও সম্মান প্রদর্শন মুমিনের জীবনের মূল লক্ষ্য।

১. নবীজি হাজির ও নাজির

আ'লা হযরত নবীজিকে 'হাজির ও নাজির' হিসেবে বিশ্বাস করার কথা অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন:

تُجھ سے چھپاؤں منہ تو کروں کس کے سامنے * کیا اور بھی کسی سے توقع نگاہ ہے

অনুবাদ: "তোমার কাছে মুখ লুকিয়ে কার সামনে করব? আর কি কারো কাছে আমার দৃষ্টির প্রত্যাশা আছে?"

অন্য এক কবিতায় তিনি বলেন:

کوئی کیوں پوچھے تیری بات رُضا * تجھ سے کتے ہزار پھرتے ہیں

অনুবাদ: "কে জিজ্ঞেস করবে তোর কথা হে রজা, তোর মতো হাজার কুকুর ঘুরে বেড়ায়।"

অর্থাৎ, নবীজির দরবারে নিজেকে তিনি এতই তুচ্ছ মনে করতেন এবং বিশ্বাস করতেন যে নবীজি সবকিছু দেখছেন ও জানছেন।

২. হায়াতুন্নবী (স.)

নবীগণ কবরে জিন্দা বা জীবিত। আ'লা হযরত এ বিষয়টি অত্যন্ত সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন:

تُو زندہ ہے واللہ تُو زندہ ہے واللہ * مری چشمِ عالم سے چھپ جانے والے

অনুবাদ: "তুমি জিন্দা হে আল্লাহর কসম! তুমি জিন্দা হে আল্লাহর কসম! আমার জগত সংসার থেকে লুকিয়ে যাওয়া সত্তা।"

৩. শাফায়াত

কিয়ামতের দিন নবীজির শাফায়াত বা সুপারিশ মুমিনদের একমাত্র ভরসা। আ'লা হযরত বলেন:

"ক্ষমার তরে তাঁর সুপারিশ খোদারই আশীষ, ক্রমান্বয়ে ভাগ্যে সবার জুটেই তো যাবে।"

৪. সাহাবীদের প্রতি আকীদা

সমস্ত সাহাবী সম্মানিত ও সত্যের মাপকাঠি। আহলে সুন্নাতের আকীদা হতে হবে সমস্ত সাহাবী সম্মানিত এবং তাঁদের সমালোচনা করা যাবে না। আ'লা হযরত বলেন:

اہل سنت کا ہے بیڑا پار اصحاب حضور * نجم ہیں اور ناؤ ہے عترت رسول الله کی

অনুবাদ: "আহলে সুন্নাতে'র তরী পার, নবীর আসহাব তারকা, আর ভরসা নূহের তরীর মত, রাসূলের আহলে বাইতের।"

পঞ্চম রুকন: আখেরাতের প্রতি আকীদা

কিয়ামত নিশ্চিত। আ'লা হযরত রহ. আখেরাতের ভয়াবহ অবস্থা এবং নিশ্চিয়তা বর্ণনা দিয়ে নবীজির সাহায্য কামনার পরামর্শ দিয়ে বলেন:

آج مدد مانگ ان سے پھر نہ مائینگے قیامت میں اگر مان گیا آج سے انکی پناہ

অনুবাদ: "আজই নে তাঁর আশ্রয়, নে রে ঠাঁই তাঁর নির্ভয়, হাশরে মানতে হবেই, তাই মেনে নে, মান, আজই মান।"

ষষ্ঠ রুকন: তাকদিরের প্রতি আকীদা

তাকদীরের ভালো মন্দ আল্লাহর নিয়ন্ত্রণে। তাকদীরের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন:

محمود اثبات کے دفتر پہ کڑوڑا تیرا میری تقدیر بری ہو تو پہلی کر دے کہ ہے

অনুবাদ: "বিধি মন্দ যদি হয়, করো হে কল্যাণময়, রাখা না রাখা বিধি, আছে তো সে অধিকার।"

এরকমভাবে আ'লা হযরত ইমাম শাহ আহমদ রেযা রহ. ছন্দের শৈল্পিকতায় কোরআন-হাদীসের আলোকে একইসাথে হামদে বারী তা'আলা, না'তে রাসূলুল্লাহ দ., শানে সাহাবা, শানে আউলিয়া বর্ণনা করে মুসলিম মিল্লাতের আকীদা সংশোধনের এক মহান দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর প্রতিটি পঙ্ক্তি যেন ঈমানের একেকটি উজ্জ্বল প্রদীপ, যা পথহারা মানুষকে সঠিক পথের সন্ধান দেয়।

Content Protection & Copyright

If you believe any content on our website infringes your rights, please contact us. We will review and take action promptly.

Post a Comment