কুরআন মুখস্থকরণ ও সংরক্ষণের গুরুত্ব

কুরআন মুখস্থকরণ ও সংরক্ষণের গুরুত্ব, কুরআন ধরে রাখার সহজ উপায়, সাহাবায়ে কিরামের আত্মত্যাগ ও সংরক্ষণ, হাফেযে কুরআনদের প্রতি নসিহত

কুরআন মুখস্থকরণ ও সংরক্ষণের গুরুত্ব

হাফেয আব্দুল মুস্তফা মুহাম্মদ নুরুল আনোয়ার
প্রভাষক, কামিল তাফসির বিভাগ
কুরআন মুখস্থকরণ ও সংরক্ষণের গুরুত্ব: পবিত্র কুরআন অবতরণের ইতিহাস, সাহাবাদের সংরক্ষণ পদ্ধতি এবং হাফেযে কুরআনদের দায়িত্ব ও আমল সম্পর্কে প্রতিটি বাক্যের পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা।

মহান আল্লাহর জন্যই সকল প্রশংসা, যিনি মানবজাতিকে সম্মানিত করেছেন, এই কুরআন অবতীর্ণ করার মাধ্যমে এবং সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক, যিনি সরদারে কায়েনাত ফখরে মওজুদাদ সাহেবে কুরআন নবী হযরত মুহাম্মাদ মোস্তফা صلى الله عليه وسلم এর উপর। আর সালাম বর্ষিত হোক রাসুলে পাক صلى الله عليه وسلم এর পরিবার-পরিজন এবং তাঁর সেই সকল সাহাবাদের উপর, যাঁরা ছিলেন জ্ঞান ঈমান ও পবিত্র কোরআনের ধারক বাহক।

আমাদের সামনে যে ত্রিশ পারার পরিপূর্ণ কালামুল্লাহ শরিফ আজ উন্মুক্ত, তা এক নিমিষে অবতীর্ণ হওয়া কোনো সাধারণ গ্রন্থ নয়। এর প্রতিটি আয়াত, প্রতিটি শব্দ এক দীর্ঘ তেইশ বছরের অবিরাম সাধনা, ত্যাগ ও সংগ্রামের জীবন্ত ইতিহাস। আরবের উত্তপ্ত মরু প্রান্তর থেকে মক্কার অলিগলি এবং মদিনার সবুজ জমিনে বিস্তৃত ছিল এর অবতরণের প্রেক্ষাপট। যখন জিবরাঈল আ. আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রথম অহী নিয়ে হেরা পর্বতের গুহায় আগমন করলেন, সেই ঐশী বাণীর গুরুভারে রাসূলুল্লাহ صلى الله عليه وسلم কেঁপে উঠেছিলেন। এরপর থেকে দীর্ঘ তেইশ বছর ধরে কখনো যুদ্ধের ময়দানে, কখনো গভীর রাতে, কখনো সাহাবাদের জিজ্ঞাসার জবাবে, আবার কখনো কঠিন পরীক্ষার মুহূর্তে একটু একটু করে এই কুরআন নাযিল হয়েছে। এর প্রতিটি আয়াত নাযিলের পেছনে রয়েছে কারণ, রয়েছে প্রেক্ষাপট এবং রয়েছে উম্মতের জন্য শিক্ষা।

সাহাবায়ে কিরামের আত্মত্যাগ ও সংরক্ষণ

রাসূলুল্লাহ صلى الله عليه وسلم এবং তাঁর সাহাবায়ে কিরাম রা. এই কুরআনকে সংরক্ষণের জন্য যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তা অতুলনীয়। তাঁদের কাছে লেখার জন্য আজকের মতো কাগজ-কলম ছিল না। তাঁরা প্রতিটি আয়াতকে কেবল শুনেই হৃদয়ে ধারণ করতেন। পাথরের টুকরো, গাছের ছাল, পশুর হাড় এবং খেজুর পাতায় লিখে রাখতেন পবিত্র আয়াতগুলো। কিন্তু তাঁদের আসল সংরক্ষণাগার ছিল তাঁদের সিনা বা হৃদয়। শত নির্যাতন, যুদ্ধ আর প্রতিকূলতার মাঝেও তাঁরা কুরআনের একটি হরফও হারিয়ে যেতে দেননি। ইয়ামামার যুদ্ধে যখন শত শত হাফেযে কুরআন সাহাবী শহীদ হলেন, তখন হযরত আবু বকর সিদ্দিক রা. এবং হযরত উমর ফারুক রা. কত গভীর উদ্বেগে কুরআনের পাণ্ডুলিপি একত্রিত করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে।

হাফেযে কুরআনদের প্রতি নসিহত

আজ আমরা যারা নিজেদের হাফেযে কুরআন বলে দাবি করি, আমাদের বুকের ভেতর সেই একই কুরআনের ৩০ পারা আমানত গচ্ছিত আছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমরা কি সেই আমানতের হক আদায় করছি? সাহাবাদের সেই ত্যাগের মর্যাদা কি আমরা দিতে পারছি?

হেফজখানা থেকে বের হওয়ার পর আমাদের অনেকের জীবনযাপনে এক বিরাট পরিবর্তন আসে। জেনারেল শিক্ষায় ব্যস্ততা, ক্যারিয়ারের চিন্তা, কিংবা দুনিয়াবি মোহে পড়ে আমরা অনেকেই কুরআনের তেলাওয়াত থেকে দূরে সরে যাই। যেই কুরআনকে বুকে ধারণ করতে আমরা শৈশবের সোনালী দিনগুলো হেফজখানার চার দেয়ালের মাঝে কাটিয়েছি, রাত জেগেছি, শিক্ষকের প্রহার সহ্য করেছি—আজ সেই কুরআন আমাদের বুক থেকে মুছে যাচ্ছে কেবল আমাদের অবহেলার কারণে।

প্রিয় হাফেয ভাই আমার! আপনি কি জানেন, কুরআনের একটি আয়াত ভুলে যাওয়া কত বড় অপরাধ? রাসূলুল্লাহ صلى الله عليه وسلم বলেছেন:

عُرِضَتْ عَلَيَّ ذُنُوبُ أُمَّتِي، فَلَمْ أَرَ ذَنْبًا أَعْظَمَ مِنْ سُورَةٍ مِنَ الْقُرْآنِ أَوْ آيَةٍ أُوتِيهَا رَجُلٌ ثُمَّ نَسِيَهَا

অর্থ: "আমার উম্মতের গুনাহসমূহ আমার সামনে পেশ করা হলো। আমি দেখলাম, যে ব্যক্তি কুরআনের কোনো সূরা বা আয়াত মুখস্থ করার পর তা ভুলে যায়, তার চেয়ে বড় গুনাহগার আর কেউ নেই।" (সুনানে তিরমিযী)

অন্য একটি হাদিসে এসেছে:

مَنْ قَرَأَ الْقُرْآنَ ثُمَّ نَسِيَهُ لَقِيَ اللَّهَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَجْذَمَ

অর্থ: "যে ব্যক্তি কুরআন পড়ল এবং এরপর তা ভুলে গেল, কিয়ামতের দিন সে আল্লাহর সাথে কুষ্ঠরোগী হয়ে সাক্ষাৎ করবে।" (সুনানে আবু দাউদ)

একবার ভেবে দেখুন, হাশরের ময়দানে যখন কুরআনের ধারক-বাহকদের সম্মানের মুকুট পরানো হবে, তখন যদি আমি বা আপনি কুরআনের আয়াত ভুলে যাওয়ার কারণে লজ্জিত ও অপমানিত হয়ে দাঁড়াই, তবে সেই লজ্জা রাখার জায়গা কি থাকবে? সেদিন আমাদের ওস্তাদজী, আমাদের মা-বাবা আমাদের দিকে তাকিয়ে কী ভাববেন?

কুরআন ধরে রাখার সহজ উপায়

আমরা হয়তো অজুহাত দিই—সময় পাই না, ব্যস্ততা অনেক। কিন্তু আসুন, একটু হিসাব করে দেখি। আমাদের দিন-রাত ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আমরা কি মাত্র ১টি ঘণ্টা আমাদের রবের কালামের জন্য দিতে পারি না?

একজন হাফেযে কুরআনের জন্য ১ পারা তেলাওয়াত করতে সর্বোচ্চ কত সময় লাগতে পারে? যদি ধীরস্থিরভাবে তারতীলের সাথেও পড়েন, তবে ১ পারা পড়তে তাঁর সর্বোচ্চ ২০ মিনিটের বেশি লাগার কথা নয়।

২০ মিনিটে ১ পারা
৬০ মিনিটে (১ ঘণ্টায়) = ৩ পারা

সুতরাং, প্রতিদিন মাত্র ১ ঘণ্টা সময় দিলে:
১০ দিনে ৩০ পারা = ১ খতম
৩০ দিনে (১ মাসে) = ৩ খতম
১২ মাসে (১ বছরে) = ৩৬ খতম
(সুবহানাল্লাহ!)

ভেবে দেখুন তো একবার! যে কুরআন খতম দিতে একসময় আমাদের বছরের পর বছর লেগে যেত, তা এখন বছরে ৩৬ বার আমাদের সজীব স্মৃতিতে ঝালিয়ে নেওয়ার সুযোগ।

উপসংহার ও প্রতিজ্ঞা

প্রিয় ভাই আমার, একবার অতীতে ফিরে যান। মা-বাবার মায়াভরা মুখ পেছনে ফেলে আসা সেই দিনগুলো, খেয়ে না খেয়ে কাটানো মুহূর্তগুলো, আর ওস্তাদজীর সেই শাসনভরা চোখের চাহনি—সবই তো ছিল এই ৩০ পারা কালামুল্লাহর জন্য। পিঠের উপর পড়া প্রতিটি বেতের দাগ তো কোনো আঘাত ছিল না, ছিল কুরআনের ভালোবাসার একেকটি সীলমোহর। যে ঐশী বাণী অর্জনের জন্য এত কষ্ট, এত ত্যাগ, সেই ৩০ পারার আমানত কি আমরা অবহেলায় নিজেদের বুক থেকে হারিয়ে যেতে দেব?

আসুন, আমরা প্রতিজ্ঞা করি। প্রতিদিন শুধুমাত্র ১টি ঘণ্টা ব্যয় করে আমাদের সেই কষ্টের ফসলকে সযত্নে আগলে রাখি। যেন হাশরের কঠিন ময়দানে আমরা আল্লাহ তা'আলা ও তাঁর প্রিয় রাসূল صلى الله عليه وسلم এর সামনে একজন লজ্জিত নয়, বরং গর্বিত হাফেযে কুরআন হিসেবে চেহারা দেখাতে পারি। যেন আমাদের বুক থেকে বিচ্ছুরিত কুরআনের নূর আমাদের জন্য সুপারিশকারী হয়ে দাঁড়ায়।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা আমাদের সকল হাফেয ভাইকে তাঁর কালামকে জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত বুকে ধারণ করার তাওফিক দান করুন। আমীন।

Content Protection & Copyright

If you believe any content on our website infringes your rights, please contact us. We will review and take action promptly.

Post a Comment