এক সফর, বহু অনুপ্রেরণা: পীরে বাঙ্গালের ২০২৫ সালের বাংলাদেশ সফর
প্রভাষক (ইংরেজি)

এটি কেবল একটি সফর ছিল না—এটি ছিল একটি অনুপ্রেরণার ঢেউ যা বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষের হৃদয় স্পর্শ করেছে। ২০২৫ সালের ৩১ আগস্ট, বাংলার পবিত্র মাটি সাক্ষী হলো নবী করিম (সা.)-এর পবিত্র বংশধরদের আগমনের। পীরে বাঙ্গাল আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ সাবির শাহ (মু.জি.আ.), সাথে ছিলেন সৈয়দ মুহাম্মদ কাসিম শাহ (মু.জি.আ.) এবং সৈয়দ মেহমুদ আহমেদ শাহ (মু.জি.আ.)। তাঁদের আগমন কেবল একটি আনুষ্ঠানিকতা ছিল না, বরং এটি ছিল ভালোবাসা, ঐক্য এবং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা'আতের পতাকাতলে ইসলামের সত্য বাণী প্রচারের এক মহান মিশন।
নবী প্রেমের সুবাসে বাংলাদেশ
আনজুমান-এ-রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট আয়োজিত পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উদযাপনের অংশ হিসেবে গ্র্যান্ড জশনে জুলুসে সভাপতিত্ব করতে এই মহান অতিথিরা বাংলাদেশে আসেন।
রাজধানী ঢাকা পরিণত হয়েছিল ভক্তির এক মহাসাগরে। অগণিত ভক্ত কালিমা তাইয়্যেবা খচিত পতাকা হাতে নিয়ে আকাশ-বাতাস মুখরিত করে তুলেছিল "নারায়ে তাকবীর - আল্লাহু আকবার", "নারায়ে রিসালাত - ইয়া রাসূলাল্লাহ", "ইয়া নবী সালাম আলাইকা" এবং "মুস্তফা জানে রহমত পে লাখো সালাম"-এর সুমধুর ধ্বনিতে।
চট্টগ্রামে আধ্যাত্মিক আলোকচ্ছটা
ঢাকার শোভাযাত্রার পর, মহান অতিথিরা ৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখে চট্টগ্রামে পৌঁছান। সেদিন হুজুর কেবলা সাবির শাহ (মু.জি.আ.)-এর নেতৃত্বে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে পবিত্র গয়ারভি শরীফ পালন করা হয়। এরপর ৬ সেপ্টেম্বর তিনি চট্টগ্রামের বিশ্বখ্যাত জশনে জুলুসে সভাপতিত্ব করেন। লক্ষ লক্ষ আশেকে রাসূল ভক্তিপূর্ণ হৃদয়ে সমবেত হন, ভক্তির পতাকা নাড়িয়ে এবং পবিত্র নবীর প্রতি তাঁদের ভালোবাসা ঘোষণা করেন।
তাঁর আধ্যাত্মিক উদ্দীপনামূলক ভাষণে, হুজুর কেবলা উম্মাহকে ইসলামের প্রকৃত সারাংশ—বিশ্বাস, করুণা এবং ঐক্য—বজায় রাখার আহ্বান জানান। তিনি সকলকে স্মরণ করিয়ে দেন যে, সুন্নাহর পথই হলো শান্তির পথ।
শিক্ষামূলক, সাংগঠনিক এবং সামাজিক দিকনির্দেশনা
এই সফর কেবল আধ্যাত্মিক সমাবেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না; এটি শিক্ষামূলক সংস্কার এবং সমাজকল্যাণের একটি দৃষ্টিভঙ্গিও বহন করেছিল। ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখে হুজুর কেবলা 'জামেয়া প্রাইমারি হেলথ কেয়ার সেন্টার' উদ্বোধন করেন, যা জামেয়ার শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের একটি মানবিক উদ্যোগ।
তিনি নির্বাহী কমিটির সভায় সভাপতিত্ব করেন এবং ট্রাস্টের সাংগঠনিক ও নৈতিক শক্তিশালীকরণের জন্য মূল্যবান দিকনির্দেশনা প্রদান করেন।
১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখে তিনি জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদ্রাসা পরিদর্শন করেন। সেখানে তিনি অ্যাসেম্বলিতে উপস্থিত হয়ে শিক্ষার্থীদের মূল্যবান নির্দেশনা দেন। এরপর তিনি শিক্ষকদের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং একাডেমিক মান উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দেন। তিনি শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সুষম অনুপাত বজায় রাখা, আধুনিক শিক্ষার সাথে ইসলামি মূল্যবোধের সমন্বয় এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে সুশৃঙ্খল চরিত্র গড়ে তোলার ওপর জোর দেন।
ঐক্য এবং একাডেমিক উৎকর্ষের আহ্বান
১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখে তিনি আনজুমান ট্রাস্ট শিক্ষা প্রশাসকদের সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন, যেখানে ট্রাস্ট পরিচালিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ এবং চেয়ারম্যানরা উপস্থিত ছিলেন। তিনি একটি অভিন্ন পাঠ্যক্রম, সমন্বিত একাডেমিক ক্যালেন্ডার এবং পুরো নেটওয়ার্ক জুড়ে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য যৌথ প্রচেষ্টার আহ্বান জানান।
একই দিনে তিনি আনজুমান-এ-রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্টের শতবর্ষ উদযাপন এবং মাসিক তরজুমান প্রকাশনার সুবর্ণ জয়ন্তীতে সভাপতিত্ব করেন। তাঁর অনুপ্রেরণামূলক ভাষণ আহলে সুন্নাতের বার্তা—জ্ঞান, ঐক্য এবং আন্তরিকতার মাধ্যমে ঐতিহ্য সংরক্ষণ—পুনরায় প্রজ্বলিত করে।
শিক্ষা ও আধ্যাত্মিক কেন্দ্র পরিদর্শন
বাংলাদেশে অবস্থানকালে হুজুর কেবলা বেশ কয়েকটি মাদ্রাসা পরিদর্শন করেন, যার মধ্যে রয়েছে হালিশহর তৈয়্যবিয়া মাদ্রাসা, মাদ্রাসা-এ-তৈয়্যবিয়া তাহেরিয়া সুন্নিয়া (আলিম), নুনিয়াছড়া, কক্সবাজার এবং পাঠনদণ্ডী তাহেরিয়া সাবেরিয়া সুন্নিয়া মাদ্রাসা। সেখানে তিনি বার্ষিক সমাবেশ এবং মিলাদুন্নবী উদযাপনে সভাপতিত্ব করেন।
তিনি বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের উদ্বোধন এবং ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন, যেমন:
- গাউসিয়া তাহেরিয়া সাবেরিয়া সুন্নিয়া মাদ্রাসা, হেফজখানা ও এতিমখানা, রাউজান
- খানকাহ-এ-কাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া তাহেরিয়া সাবেরিয়া, রাউজান
- কদলপুর তৈয়্যবিয়া তাহেরিয়া সুন্নিয়া মহিলা মাদ্রাসা, রাউজান
- খানকাহ-এ-সৈয়দ আহমদ শাহ সিরিকোটি, ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম
- তাহেরিয়া জামে মসজিদ, খিলগাঁও, ঢাকা
- কাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া কামিল মাদ্রাসা পরিদর্শন, মোহাম্মদপুর, ঢাকা
এই সফরের সময় আরেকটি উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ ছিল "গাউসিয়া কমিটি ডক্টরস উইং" গঠন—যা ইসলামি দাওয়াতের সাথে স্বাস্থ্যসেবা এবং মানবিক সেবার এক মহৎ সমন্বয়।
ইমাম সম্মেলন - দাওয়াতের এক নতুন অধ্যায়
এই সফরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন মসজিদের ইমামদের সাথে একটি বিশেষ বৈঠক। হুজুর কেবলা তাঁদের বিশাল দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেন: "আপনারা আপনাদের সমাজের আধ্যাত্মিক নেতা। মানুষ আপনাদের কাজের মাধ্যমে ইসলামকে দেখে। তাই, সুন্নাহর শিক্ষা সংরক্ষণ ও প্রচারে আপনাদের সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে হবে।" তাঁর ভাষণ একটি গভীর ছাপ ফেলে—সত্য ও হেদায়েতের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য আলেম ও ইমামদের প্রতি এক উদাত্ত আহ্বান।
প্রতিফলন এবং উত্তরাধিকার
এই সফরটি কেবল একটি ঘটনা ছিল না—এটি ছিল ভালোবাসা, জ্ঞান এবং সেবার এক জীবন্ত বার্তা। এই তিন মহান ব্যক্তিত্ব মেহরাব ও মিম্বর, বুদ্ধি ও ভক্তি, নেতৃত্ব ও বিনয়ের ঐক্যের মূর্ত প্রতীক ছিলেন। তাঁদের উপস্থিতির মাধ্যমে তাঁরা সারা বাংলাদেশে সুন্নাহ, শৃঙ্খলা এবং সামাজিক সম্প্রীতির শিখা পুনরায় প্রজ্বলিত করেছেন। ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখে তাঁরা পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে রওনা হন, কিন্তু রেখে যান অনুপ্রেরণার এক উত্তরাধিকার যা হৃদয় ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে আলোকিত করে চলেছে।
পীরে বাঙ্গাল আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ সাবির শাহ (মু.জি.আ.), সৈয়দ মুহাম্মদ কাসিম শাহ (মু.জি.আ.) এবং সৈয়দ মেহমুদ আহমেদ শাহ (মু.জি.আ.)-এর সফর বাংলাদেশে এক অবিস্মরণীয় ছাপ রেখে গেছে—ঈমান পুনরুজ্জীবিত করা, জ্ঞান বিস্তার করা এবং সুন্নাহর শাশ্বত সৌন্দর্য তুলে ধরার এক আহ্বান।
If you believe any content on our website infringes your rights, please contact us. We will review and take action promptly.