ওয়াদা পালন: কুরআন ও হাদিসের আলোকে গুরুত্ব

ওয়াদা পালন বা প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা মুমিনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য এবং ইসলামের এক মৌলিক শিক্ষা। আল্লাহ তা'আলা পবিত্র কুরআনে মুমিনদের গুণাবলি বর্ণনা করতে গিয়ে আমানত ও ওয়াদা রক্ষার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। অপরদিকে, ওয়াদা ভঙ্গ করাকে মুনাফিকের লক্ষণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই প্রবন্ধে আমরা কুরআন ও হাদিসের আলোকে ওয়াদা পালনের গুরুত্ব, ফজিলত এবং ওয়াদা ভঙ্গ করার ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে বিস্তারিত জানব।
ওয়াদা পালন বা অঙ্গীকার পূরণ করাকে আরবিতে إِيْفَاءُ الْوَعْدِ বলা হয়। এটি সামাজিক শান্তি ও পারস্পরিক বিশ্বাসের ভিত্তি। নিচে কুরআন ও হাদিস থেকে এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ দলিলসমূহ তুলে ধরা হলো।
আল কুরআন থেকে দলিল
১. আল্লাহ তা'আলা মুমিনদের গুণাবলি বর্ণনা করতে গিয়ে ইরশাদ করেন:
অনুবাদ: ‘আর যারা নিজেদের আমানতসমূহ ও অঙ্গীকারে যত্নবান।’ (সূরা মুমিনুন-২৩ : ৮)
২. অঙ্গীকার পূর্ণ করার নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ বলেন:
অনুবাদ: ‘হে মুমিনগণ, তোমরা অঙ্গীকারসমূহ পূর্ণ করো। তোমাদের জন্য গৃহপালিত চতুষ্পদ জন্তু হালাল করা হয়েছে, তোমাদের নিকট যা বর্ণনা করা হচ্ছে তা ছাড়া। তবে ইহরাম অবস্থায় শিকারকে হালাল করবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ যা ইচ্ছা বিধান দেন।’ (সূরা মায়িদা-৫ : ১)
৩. আল্লাহর সাথে কৃত ওয়াদা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে:
অনুবাদ: ‘আর এরা পূর্বেই আল্লাহর সাথে অঙ্গীকার করেছিল যে, তারা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে না। আর আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।’ (সূরা আহজাব-৩৩ : ১৫)
৪. কসম বা শপথ ভঙ্গের নিষেধাজ্ঞা:
অনুবাদ: ‘আল্লাহর সাথে যখন কোনো মজবুত ওয়াদা কর তখন তা পালন কর। আর পাকা কসম খাওয়ার পর তা ভেঙে ফেল না। অথচ তোমরা আল্লাহকে তোমাদের ওপর সাক্ষী বানিয়েছ। তোমরা যা কিছু করো আল্লাহ সবই জানেন।’ (সূরা নাহল-১৬ : ৯১)
৫. মুশরিক ও জালিমদের মিথ্যা ওয়াদা:
অনুবাদ: ‘বলো তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের ডাক, সেই শরিকদের কথা ভেবে দেখেছ কি? আমাকে দেখাও তারা জমিনের কী সৃষ্টি করেছে? অথবা আসমানসমূহের মধ্যে কি তাদের কোনো অংশীদারিত্ব আছে? অথবা আমি কি তাদের কোনো কিতাব দিয়েছি, যার কোনো সুস্পষ্ট প্রমাণের ওপর তারা আছে? বরং জালিমরা একে অপরকে কেবল প্রতারণামূলক ওয়াদাই দিয়ে থাকে।’ (সূরা ফাতির-৩৫ : ৪০)
৬. অঙ্গীকার সম্পর্কে জবাবদিহিতা:
অনুবাদ: ‘আর তোমরা ইয়াতিমের সম্পদের কাছে যেয়ো না সুন্দরতম পন্থা ছাড়া, যতক্ষণ না সে বয়সের পূর্ণতায় উপনীত হয়। আর অঙ্গীকার পূর্ণ করো, নিশ্চয়ই অঙ্গীকার সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’ (সূরা বনি ইসরাইল-১৭ : ৩৪)
আল হাদিস থেকে দলিল
১. মুনাফিকের আলামত:
অনুবাদ: হজরত আবু হুরায়রা (রা.) নবি কারিম (সা.) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, ‘মুনাফিকের চিহ্ন তিনটি। ১. যখন সে কথা বলে মিথ্যা কথা বলে। ২. যখন ওয়াদা করে তা ভঙ্গ করে। ৩. আর যখন তার কাছে আমানত রাখা হয় বিশ্বাসঘাতকতা করে।’ (বুখারি : বাবু আলামাতিল মুনাফিক-৩২, মুসলিম বাবু বায়ানি খিসালিল মুনাফিক : ইফা-১১৫)
২. খাঁটি মুনাফিকের পরিচয়:
অনুবাদ: হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) বর্ণনা করেন, নবি কারিম (সা.) বলেন, ‘চারটি গুণ যার মাঝে আছে সে খাঁটি মুনাফিক। আর যার মাঝে চারটির যে কোনো একটি রয়েছে, তার মাঝে নিফাকের একটি চিহ্ন রয়েছে, যতক্ষণ পর্যন্ত সে তা না ছাড়ে। ১. যখন আমানত রাখা হয় খেয়ানত করে। ২. যখন কথা বলে মিথ্যা বলে। ৩. যখন চুক্তি করে তা লঙ্ঘন করে। ৪. এবং যখন ঝগড়া করে গালিগালাজ করে।’ (বুখারি : বাবু আলামাতিল মুনাফিকে, ৩৩, মুসলিম : বাবু বায়ানি খিসালিল মুনাফিকি : ইফা-১১৪)
৩. বিশ্বাসভঙ্গকারীর পরিণাম:
অনুবাদ: হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন প্রত্যেকটি প্রতারকের জন্যে (প্রতারণার নিদর্শনস্বরূপ) একটি করে পতাকা থাকবে। তার প্রতারণার পরিমাণ অনুযায়ী তাদের পতাকাসমূহ উঁচু-নিচু করা হবে। জেনে রাখো! জনগণের শাসক হয়েও যে বিশ্বাসঘাতকতা করে, তারচেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতক আর নেই।’ (মুসলিম : বাবু তাহরিমিল গাদরি : ইফা-৪৩৮৮)
৪. কিয়ামতের দিন আল্লাহর প্রতিপক্ষ:
অনুবাদ: হজরত আবু হুরায়রা (রা.) নবি কারিম (সা.) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা বলেছেন, তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে কিয়ামতের দিন আমি স্বয়ং অবস্থান করব। ১. যে ব্যক্তি আমার নামে চুক্তিবদ্ধ হয়ে তা ভঙ্গ করেছে। ২. যে ব্যক্তি কোনো স্বাধীন ব্যক্তিকে বিক্রি করে তাঁর মূল্য ভোগ করেছে। ৩. যে ব্যক্তি কোনো শ্রমিককে কাজে নিয়োগ করে পূর্ণ কাজ আদায় করে নেয়, অথচ তার বিনিময় দেয় না।’ (বুখারি : বাবু ইসমে মান বাআ হুররান : ইফা-২০৮৬)
If you believe any content on our website infringes your rights, please contact us. We will review and take action promptly.